কেনো? বিদ্রোহী হিমুর সেনাবাহিনীর একটি অগ্রবর্তী সৈন্যদলের কাছে দিল্লীর পতন হয়েছে।
*
চার ঘন্টা পর, আকবর এবং তাঁর শিকারের সঙ্গীরা শিবিরের প্রথম নিরাপত্তা বেড়া অতিক্রম করলো। সূর্য তখন পরিচ্ছন্ন নীল আকাশে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। যদিও ছাতার ছায়ায় রয়েছেন, তারপরও আকবরের মাথা ব্যথা করছিলো। ঘামে তার পোষাক শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে, তবুও এইসব অসুবিধা তাঁকে খুব একটা কষ্ট দিচ্ছিলো না রাজধানী দিল্লীর পতনের ভয়াবহ সংবাদ তাকে যতোটা ভাবাচ্ছিলো। শাসনকার্য শুরুর আগেই কি তাঁর শাসন আমলের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে?
দশ মাসও পার হয়নি এক মোগল শিবিরে অস্থায়ীভাবে ইটের তৈরি সিংহাসনে তড়িঘড়ি করে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার পিতা সম্রাট হুমায়ূনের আকস্মিক মৃত্যুর শোক এখনো তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত। কিছুটা বিব্রত কিন্তু গর্বিত ভঙ্গীমায় তিনি বৈরাম খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য শিবিরের সম্মুখে টাঙ্গানো রেশমের চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়ালেন।
বর্তমানে যে দুঃসময় তারা অতিক্রম করছেন এর গুরুত্ব তাঁর মা হামিদা তাকে বুঝাতে পেরেছিলেন। পারসিক হওয়া সত্ত্বেও বৈরাম খান অন্য যে কোনো উপদেষ্টার চেয়ে তার নিরাপত্তা বিধানে অনেক বেশি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। বৈরাম খান আঁচ করতে পেরেছিলেন আকবরের পিতার মৃত্যুর পর তার জন্য বিপদ সৃষ্টি হবে ভিতর থেকেই-উচ্চাকাক্ষী সেনাপতিরা ভাবছে এখন যখন হুমায়ূন মৃত এবং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেখে গেছেন একটি মাত্র বালক পুত্রসন্তান, এটাই সিংহাসন দখলের উপযুক্ত সময় তাঁদের জন্য। তাদের অধিকাংশের মধ্যেই ভাবাবেগের অস্তিত্ব নেই। তাঁদের অনেকেই পুরানো মোগল গোত্র গুলির সদস্য যারা হিন্দুস্তানের শুষ্ক সমভূমিতে একটি নতুন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনে আকবরের পিতামহ সম্রাট বাবরের সঙ্গী ছিলো। সিংহাসন অথবা খাঁটিয়া সর্বদা এই মনোভাব দ্বারাই তারা চালিত হয়েছে। যে কেউ নিজেকে যোগ্য এবং শক্তিশালী ভেবেছে সেই সিংহাসন অধিকারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। বিগত বছর গুলিতে অনেকেই এমন অনেকেই এমন প্রয়াস চালিয়েছে। এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে সন্দেহ নেই।
আকবর ভাবছেন যদি দিল্লীর পতনের দুঃসংবাদ সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তার মা এবং বৈরাম খান তার জন্য এতোদিন যা কিছু করেছেন সব ব্যর্থতায় পর্যবশিত হলো। মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার করার জন্য তারা হুমায়ূনের মৃত্যু সংবাদটি প্রায় দুসপ্তাহ গোপন রেখেছিলেন। মৃত সম্রাটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রায় একই দৈহিক গড়নের একজন বিশ্বস্ত অনুচরকে হুমায়ূনের ভূমিকায় নিয়োজিত করেছিলেন তাঁরা। রীতি অনুযায়ী সে প্রতিদিন ভোরে সম্রাটের রেশমের সবুজ পোষাক এবং রত্নখচিত পাগড়ি পড়ে দিল্লীর রাজপ্রাসাদ পুরানো-কেল্লার যমুনা তীরবর্তী বারান্দায় হাজিরা দিয়েছে প্রজাদের বোঝানোর জন্য যে সম্রাট এখনো জীবিত আছেন।
ইতোমধ্যে, মা হামিদা এবং ফুফু গুলবদন অনিচ্ছুক আকবরকে গোপনে দিল্লী ত্যাগ করতে রাজি করান। প্রদীপের কম্পিত আলোয় মায়ের উদ্বিগ্ন মুখটি এখনো তার চোখে ভাসছে যখন তিনি তাঁর শয়ন কক্ষে এসে তাকে ডেকে তুলেন এবং ফিসফিস করে বলেন, তাড়াতাড়ি করো, সঙ্গে কিছু নেবার দরকার নেই-জলদি! আচমকা ঘুম ভেঙ্গে উঠে আকবর দেখেন মা তার গায়ে মস্তক আবরণ যুক্ত একটি কালো আলখাল্লা পড়িয়ে দিচ্ছেন, তিনি নিজেও অনুরূপ একটি আলখাল্লা পড়ে আছেন। তখনো ঘুমের রেশ কাটেনি, মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে প্রসাদের গুপ্ত সিঁড়ি পথে (যে সম্পর্কে আগে তিনি জানতেন না) তিনি তার মাকে অনুসরণ করে একটি অপরিচ্ছন্ন উঠানে উপস্থিত হোন। সেখানকার বাতাসে মানুষ অথবা পশুর প্রস্রাবের যে তীব্র গন্ধ ভাসছিলো-সেটা এখনো তার মনে আছে।
সেখানে একটি বড় টানা-গাড়ি অপেক্ষা করছিলো এবং আঁধারের ছায়ায় ফুফু গুলবদন এবং প্রায় বিশজন বৈরাম খানের অনুগত সৈন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। গাড়িতে উঠে পড় হামিদা ফিসফিস করে বলে ছিলেন।
কেনো, আমরা কোথায় যাচ্ছি? তিনি জিজ্ঞেস করেন।
এখানে থাকা তোমার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর কোনো প্রশ্ন করো না। যা বলছি করো।
আমি পালাতে চাই না। আমি কাপুরুষ নই। ইতোমধ্যেই রক্ত এবং যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে… তিনি প্রতিবাদ করেন।
গুলবদন এগিয়ে এসে তার বাহু আকড়ে ধরে বললেন, যখন তুমি শিশু ছিলে এবং তোমার জীবন বিপন্ন হয়েছিলো তখন তোমাকে বাঁচাতে আমি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছি। আমার উপর আস্থা রাখো এবং তোমার মা যা বলছে করো…।
তর্ক করা অব্যাহত রেখেই আকবর টানা-গাড়িতে চড়লেন, হামিদা ও গুলবদন তার পিছুপিছু গাড়িতে উঠে এলেন এবং তারা দ্রুত গাড়িটির পর্দা টেনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা গাড়ি টানার হাতল কাঁধে তুলে নিয়ে রাতের নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে যাত্রা শুরু করলো। গুলবদন ও হামিদা চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন এবং তাঁদের দুশ্চিন্তার অংশবিশেষ অবশেষে আকবরের মাঝে সঞ্চারিত হলো, যদিও তিনি ঠিক বুঝতে পারছিলেন না এসব কি হচ্ছে। এক সময় তারা যখন রাজপ্রাসাদ থেকে অনেক দূরে শহরের শেষ সীমায় পৌঁছালেন তখন তার মা মুখ খুললেন। জানালেন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহনের আগেই তাকে হত্যা করার এক গোপন ষড়যন্ত্রের কথা।