আকবর এখন নিজের ক্রোধ দমন করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। তাঁর উচিত আদম খানের মাঝে বোধের উদয় ঘটানো। ভাই আমার, আমরা একত্রে অনেক কিছু করেছি এবং আমি তোমার মায়ের ঋণ কোনোদিন ভুলবো না। আমি ভেবেছিলাম অশ্ব বিশেষজ্ঞের পদটি তোমার পছন্দ হবে। আমি আমার সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি ঘটাতে চাই। কিন্তু তা করতে হলে প্রথমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আমার সেনাবাহিনী এর জন্য প্রস্তুত। দ্রুতগতি সর্বদাই মোগলদের একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমাদের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের জন্য, আমাদের অশ্বারোহী তিরন্দাজ এবং বন্দুকধারীদের জন্য শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী ঘোড়া প্রয়োজন। হিমুর বিরুদ্ধে অভিযানের পর আমাদের আস্তাবলে নতুন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তোমাকে সমগ্র সাম্রাজ্য ভ্রমণ করতে হবে প্রয়োজন হলে তুমি তুরস্ক, পারস্য আরব দেশে যাবে। কিন্তু তোমাকে জোগাড় করে আনতে হবে শ্রেষ্ঠ জানোয়ার গুলি।
আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে যা ঘটলো এসো আমরা তা ভুলে যাই। আকবর তার হালকা সবুজ জোব্বায় নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত উপেক্ষা করে তাকে আলিঙ্গন করলেন। কিন্তু আদম খানের আড়ষ্ট শরীর সাড়া দিলো না। আকবর তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলেন। আমি এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকে কিছু বলবো না, এই ঘটনা শুনলে তিনি ভীষণ আহত হবেন।
কিন্তু আমি কি বলবো; এই, যে ঘোড়া থেকে পড়ে আমার নাক ভেঙ্গে গেছে? আদম খানের কন্ঠে এখনো বিদ্রুপের ছোঁয়া।
তোমার যা খুশি বলতে পারো। ঐখানে গামলায় পানি আছে, নিজেকে পরিষ্কার করে নাও। আকবর ভাবলেন এভাবে রাগে উন্মত্ত হওয়া তার ঠিক হয়নি। এটা কিছুতেই তাঁর উপযুক্ত আচরণ নয়। তিনি এখন আদম খানের সম্রাট, তার সমপর্যায়ের নন। তাদের উভয়েরই সেটা মনে রাখা উচিত ছিলো।
*
এবারের বর্ষাকালটা বেশ আগেই শুরু হয়েছে, ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে ঝরা অবিরাম বৃষ্টি নিচের সিক্ত জগতটাকে যেনো গ্রাস করতে চাইছে। যমুনার ফেঁপে ওঠা জল দুই সপ্তাহ আগে এর পাড় প্লাবিত করেছে এবং তখন থেকে অস্বাস্থ্যকর জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পলি দুর্গের ভিতর প্রবেশ করছে-ভেড়া এবং কুকুর গুলিকে ডুবিয়ে দিয়েছে, এমনকি একটি উটকেও। হিন্দুস্তানের এই ঋতুটিকে আকবর সবচেয়ে অপছন্দ করতেন, যখন সবকিছুই আর্দ্রতার আক্রমণে পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়। গ্রীষ্মের উষ্ণতার বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ গুলিতে এবং হেরেমে কয়েক ঘন্টার জন্য কর্পূরকাঠ জ্বালা হয়। যাতে মহামূল্য রেশম, কিংখাব এবং মখমল গুলি রক্ষা পায় পোকামাকড় এবং আর্দ্রতার আক্রমণ থেকে।
মায়ালার কক্ষে লাল চাদর ঢাকা বিছানায় নগ্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা আকবর কর্পূরের হালকা ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন। আকবরের শরীরকে আরাম দেয়ার জন্য এবং তার মাথা ব্যাথা দূর করার জন্য মায়ালা তাঁর পিঠ এবং কাঁধ মালিশ করে দিচ্ছিল খুবানির(বাদাম) তেল দিয়ে। প্রতি বর্ষাতেই তিনি এই মাথাব্যাথা দ্বারা আক্রান্ত হোন এবং সারাদিন অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁর পিতারও একই সমস্যা ছিলো। তরুণ অবস্থায় এর জন্য হুমায়ুনের প্রিয় উপসম ছিলো মদের মধ্যে ওপিয়াম গুলে পান করা। কিন্তু তার এই আসক্তির জন্য তিনি প্রায় সিংহাসন হারাতে বসেছিলেন এবং আকবরকে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
মালিশ করে দেয়ার জন্য হুমায়ুনের যদি মায়ালার মতো কেউ থাকতো তাহলে হয়তো তাঁর ওপিয়ামের প্রয়োজন হতো না, আকবর ভাবলেন। তিনি তৃপ্তিতে ঘড় ঘড় শব্দ করছেন যখন মায়ালার নরম হাতের তালুগুলি দক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার পেশী সমূহের উপর কর্মরত। মায়ালা তাঁকে হাসাতেও পারে। একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক হিসেবে সে আকবরের দরবারের সকল সদস্যের অনুকরণ করতে পারতো। গৃহস্থালীর রসদ সংরক্ষক জওহর থেকে শুরু করে প্রধান সেনাপতি আহমেদ খান পর্যন্ত সকলেই তার নির্দয় অনুকরণের শিকার হতেন।
আকবর তাঁর বলিষ্ঠ শরীরটি টানটান করলেন-যা দৃঢ় এবং প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য, তার অধীনস্থ যে কোনো সৈন্যের মতোই। মায়ালার দক্ষ মালিশের প্রভাবে তাঁর মাথাব্যাথা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। উপুর অবস্থায় হাতের উল্টোপিঠে মাথা রেখে তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চ স্বরে গোলযোগের শব্দ তার কানে এলো। ভীষণ ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাপিয়ে একটি পরিচিত শব্দ ভেসে এলো ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের শব্দ। কেউ লড়াই করছে। তিনি নারীকন্ঠের চিৎকার শুনলেন এবং তার পাশাপাশি তাঁর বহু পরিচিত গভীর একটি কণ্ঠস্বর চিৎকার করছে, আকবর! কাপুরুষ, সাহস থাকলে বের হয়ে এসে আমার মুখোমুখি হও…
আকবরের নিদ্রাচ্ছন্নতা উবে গেলো, তিনি ঝট করে উঠে পড়লেন, একটু থামলেন শুধু তাঁর ছোরাটা নেয়ার জন্য, তারপর নিজের নগ্নতার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মায়ালার কক্ষ থেকে খোলা উঠানে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে, সাধারণত উঠানের মধ্যবর্তী ঝর্নাটাকে ঘিরে মেয়েরা নাচে, গান গায় অথবা নিজেদের মধ্যে গল্প করে। কিন্তু এখন সেখানে একটি মাত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে-আদম খান, হেরেমের প্রবেশ দ্বারের একটু ভিতরে। তার একহাতে একটি তলোয়ার এবং আরেক হাতে একটি ছোরা। তার পেছনে দুজন হেরেমরক্ষীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। আকবর আদম খানের দিকে তাকালেন।