আকবর তার সিংহাসনে ফিরে গেলেন। এবার তুমি আতগা খান। তোমার বহু সেবা মূল্যায়ন করে আমি তোমাকে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদে নিযুক্ত করলাম।
আতগা খান, একজন লম্বা গড়নের চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট লোক। একটি চিকন সাদা ক্ষত তার বাম চোখের ভ্রু থেকে অক্ষিকোটরের নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত। বহু বছর আগে খাইবার গিরিপথের পাসাই উপজাতীয়দের এক গুপ্ত আক্রমণের স্মৃতিচিহ্ন। সে তার ডান হাতটি বুকের উপর রেখে ঝুঁকে কুর্ণিশ করলো। ধন্যবাদ জাঁহাপনা। আপনি আমাকে মহা সম্মানে ভূষিত করলেন। তাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কারুকাজ করা জোব্বা উপহার দেয়া হলো এবং জেড পাথরের সিলমোহর যা তার পরিচয়সূচক চিহ্ন বহন করে। এবারে আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং দরবার ত্যাগ করলেন।
সম্মুখে এবং পিছনে দেহরক্ষী নিয়ে আকবর যখন প্রায় তাঁর বিশ্রাম কক্ষের সামনে পৌঁছলেন ঠিক তখনই আদম খান পাশের একটি করিডোর দিয়ে তড়িৎ বেগে এগিয়ে এলো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে- সন্দেহ নেই আকবরের নাগাল পাওয়ার জন্য সে দরবার থেকে দৌড়ে এসেছে। সে কে চিনতে পারলেও আকবরের দেহরক্ষীরা আড়াআড়িভাবে বর্শা ধরে তার পথরোধ করলো। তাদের উপর হুকুম ছিলো অনুমতি ছাড়া কেউ যেনো সম্রাটের নিকটবর্তী হতে না পারে এবং একাজে অবহেলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঠিক আছে, আসতে দাও। আকবর রক্ষীদের আদেশ দিলে তারা বর্শা সরিয়ে পথ করে দিলো। কি ব্যাপার আদম খান?
দরবারের সকলের সামনে তুমি আমাকে অপমান করেছে। সে এতো ক্রুদ্ধ ছিলো যে আকবর লক্ষ করলেন তার কপালের শিরা দপ দপ করে লাফাচ্ছে।
তোমাকে অপমান করেছি? সতর্ক হয়ে কথা বলো আদম খান, আকবর নিচু স্বরে বললেন কিন্তু আদম খান নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করলো না।
তুমি সকলের সামনে আমাকে বোকা প্রতিপন্ন করেছো! এবার মনে হলো তার গলার স্বর আরো একধাপ উপরে উঠেছে। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুস্তির কৌশলে মাটিতে শুইয়ে ফেলার তীব্র আকাক্ষা অনুভব করলেন আকবর, যেমনটা বাল্যকালে বহুবার করেছেন। আদম খান সর্বদাই রাগী ছিলো কিন্তু আকবর ছিলেন তার চেয়ে দক্ষ লড়িয়ে। কিন্তু অতীতে সেটা ছিলো শিশুসুলভ বৈরিতা এবং তাদের মাঝে তখন অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিলো। হয়তো এখন তাঁদের মধ্যে আর সেই বন্ধুত্ব বজায় নেই…তার উদ্ধত আচরণ প্রত্যক্ষ করে আকবর ভাবলেন তিনি সত্যিকার অর্থে তাকে কতোটা চিনেন। এতোদিন তাঁর মনে হয়েছে তিনি তাকে ভালোই চিনেন কিন্তু হঠাৎ আজ মনে হচ্ছে তিনি এ ব্যাপারে আর নিশ্চিত নন।
দেহরক্ষী এবং অনুচরদের কৌতূহলী দৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন হয়ে তিনি খপ করে আদম খানের হাত ধরলেন। তুমি যাই আমাকে বলতে চাও তার জন্য উপযুক্ত জায়গা এটা নয়। আমার সঙ্গে এসো। তাকে নিয়ে আকবর নিজ কক্ষে প্রবেশ করলেন। যখন তাদের পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, তিনি আদম খানের হাত ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখী হলেন। তুমি কি নিজের অবস্থান ভুলে গেছো, তিনি বললেন ঠাণ্ডা গলায়।
না, বরং তুমিই ভুলে গেছো আমি কে।
একটু আগে আমি তোমাকে আমার প্রধান অশ্ববিশেষজ্ঞের পদে নির্বাচন করেছি। ভেবেছিলাম এই পদ লাভ করে তুমি আনন্দিত হবে।
তোমার আস্তাবল রক্ষক হয়ে আমি আনন্দিত হবো? এর থেকে উন্নত পদ আমার জন্য প্রযোজ্য। হিমুর সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে আমার প্রতি তোমার আচরণ বদলে গেছে…আমরা এমন সাথী ছিলাম যারা সবকিছু এক সাথে করতো কিন্তু তুমি আমাকে বর্জন করেছো। তুমি আর এখন আমাকে জিজ্ঞাসা করো না আমি কি ভাবি। আমার শিরায়ও রাজকীয় মোগল রক্ত প্রবাহিত। আমার পিতা তোমার বাবার ফুফাতভাই ছিলেন…
কোনো পদটি তুমি আশা করেছিলে? আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদটি, নাকি প্রধান সেনাপতির? আমি ঐ পদ গুলির জন্য এমন ব্যক্তি নির্বাচন করেছি যারা তাদের যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছে…এমন ব্যক্তি যাদের আমি বিশ্বাস করতে পারি।
তোমার দুধভাই ছাড়া আর কাকে তুমি বেশি বিশ্বাস করতে পারো?
সেটা দুধ-ভাই এর উপরই নির্ভর করে। কথাগুলি আকবরের মুখ থেকে সহজাতভাবে বের হয়ে এলো, তিনি নিজেকে দমাতে পারলেন না।
তুমি কি বোঝাতে চাইছো? যখন আকবর, আদম খানের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না সে বলে চললো, তুমি সেই অপহৃত রক্ষিতাঁদের ঘটনা বোঝাতে চাইছো তাই না? আমি তোমাকে বলেছি, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সেটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলো। কেউ ঐ ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো।
কেনো কেউ এমনটা করবে? তুমি এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নও যাকে কেউ ধ্বংস করতে চাইবে…বৈরাম খান আমাকে সতর্ক করেছিলেন যে তুমি নিজের সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করো।
হ্যাঁ সেই মহান বৈরাম খান। তার উপদেশ যদি এতোই মূল্যবান ছিলো তোমার কাছে তাহলে তুমি তাকে নির্বাসিত করেছিলে কেনো?
আমদ খানের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি সহ্য করা আকবরের পক্ষে আর সম্ভব হলো না। নিজের অজান্তেই তিনি তার মুখের উপর প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন এবং আদম খান মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়লো। আকবর দুপা পিছিয়ে এসে প্রস্তুত হয়ে রইলেন যদি তার দুধভাই আচমকা তাঁকে আক্রমণ করে এই কথা ভেবে। কিন্তু আদম খান তেমন কিছু করলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলো এবং তার রক্তাক্ত নাক দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকিয়ে রইলো।