এটা মিথ্যা কথা! কেউ হয়তো তাকে ঘুষ দিয়েছে আমাকে লাঞ্ছিত করার জন্য।
তাহলে তুমি কি আমার কাছে শপথ করছো যে তুমি বা তোমার লোকেরা ওদের অপহরণ বা খুনের সঙ্গে জড়িত নয়?
আমি তোমার দুধভাই হিসেবে শপথ করে বলছি। আদম খানের শক্ত হাত আকবরের হাত আঁকড়ে ধরলো। আমি কখনোই আমাদের মাঝের বন্ধনকে অবমাননা করিনি।
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।
শায়জাদা নামের মেয়েটি এখন কোথায়?
এখানে আমার হেরেমে। আমি তাকে তার বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলাম কিন্তু সে যেতে চায়নি। আমার ফুফু তার ঘটনা শুনে তার প্রতি সদয় হোন এবং নিজের কাছে রাখার প্রস্তাব করেন।
আদম খান কিছু বললো না কিন্তু আকবর লক্ষ্য করলেন তার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। তোমার ওকে দোষী ভাবা ঠিক হবে না আদম খান। যখন সে তোমার নাম বলেছে তখন সে জানতো না তুমি কে এবং তার শোনায় ভুলও হতে পারে। এছাড়া তখন সে প্রচণ্ড ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলো। তবে আমি নিশ্চিত তাকে কেউ জোরপূর্বক বা ঘুষ দিয়ে অভিযোগের কথা বলায়নি। এখন এসো আমরা কোনো ভালো বিষয় নিয়ে কথা বলি। আমি একটি শংকর স্ট্যালিয়ন ঘোড়া দেখেছি যেটার ব্যাপারে তোমার মতামত প্রয়োজন…
সাধারণ বিষয়ের অবতাড়না করতে পেরে আকবর যেনো স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর দুধ-ভাইকে প্রশ্ন করে তিনি বিব্রত বোধ করছেন, কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। আদম খান যেমন ক্ষুব্ধ ভাবে মরিয়া হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে সেটাও আকবরের জন্য স্বস্তিকর ছিলো। তবে আকবর অনুভব করছিলেন তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। আদম খানকে তার নির্দোষ হওয়া না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে তাদের বাল্যকালের অন্তরঙ্গতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম করার উপায়ও ছিলো না কারণ তিনি এখন সম্রাট।
.
০৫. দুধ এবং রক্ত
মে মাসের এক আর্দ্র দুপুর। আকবর শুয়ে আছেন মায়ালার আকর্ষণীয় কোমল পেটের উপর মাথা রেখে। তাঁর মাথার উপর ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে তৈরি টানা পাখা বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। এই মাত্র তারা অভিনব এক রতিকর্মের পালা উপভোগ করেছেন, যাতে শরীরের সব শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়েছে। আকবরের চিন্তায় তখন কেবল আনন্দময় উপাদান থাকার কথা। কিন্তু পক্ষান্তরে অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্য তাঁর মনের প্রেক্ষাপট দখল করে রেখেছিলো। তিনি কষ্টে প্রকম্পিত হচ্ছিলেন এবং মৃদু আর্তনাদও করছিলেন। কপালে একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে তিনি চমকে উঠে বসলেন। সেটা ছিলো মায়ালার হাত, সে আকবরকে আরাম দিতে চেষ্টা করছিলো। সেই দুই তরুণীর মৃতদেহ আবিষ্কারের পর থেকেই তাঁর এমন অনুভূতি হচ্ছে, যদিও তারপর আট সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন তিনি আরো বেশি চিন্তাক্লিষ্ট ও সতর্ক হয়ে উঠছিলেন এক অজানা হুমকির আশংঙ্কায়। এই বোধ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছিলো কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না আক্রমণটা কোনো দিক থেকে আসবে।
আকবর নিজের গরম হয়ে ওঠা কপালের উপর থেকে কালো চুলগুলি পেছনে ঠেলে দিলেন। তিনি তাঁর পিঠের উপর মায়ালার নগ্ন স্তনযুগলের স্পর্শ পেলেন, সে পেছন থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। সে আকবরের কানে ফিসফিস করে কিছু বলছিলো-একটি নতুন রতিভঙ্গিমার কথা-সিংহের মিলন রীতি- হয়তো তাকে সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারবে। কিন্তু প্রস্তাবটি প্রলুব্ধকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি মায়ালার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে সভা আহ্বান করেছেন আজই বিকালে এবং সভার আগে তাঁকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে।
বৈরাম খান নির্বাসিত এবং নিহত হওয়ার পর তাঁর প্রধানসেনাপতির পদটি শূন্য রয়েছে। এখন সময় হয়েছে এই পদে নতুন একজনকে নিয়োগ দেয়ার এবং একই সঙ্গে আরো কয়েকটি নিয়োগ দিতে হবে যাতে তিনি তাঁর গতানুগতিক কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন। তাছাড়া উজিরের পদটিও পূরণ করা দরকার-যদিও বৈরাম খান থাকতে এ পদে কাউকে নিয়োজিত করার প্রয়োজন ছিলো না। তবে উজির নিয়ে খুব একটা তাড়াহুড়া নেই। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার আগে সভাসদদের সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একজন দুর্নীতিপরায়ণ এবং আত্মকেন্দ্রীক উজিরের চেয়ে কোনো উজির না থাকাই উত্তম। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে তার সেনাবাহিনীর জন্য একজন প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক (চিফ কোয়ার্টার মাস্টার) প্রয়োজন। বর্তমানে যে এই পদে কর্মরত সে অত্যন্ত অল্পবয়সে আকবরের পিতামহ বাবরের অধীনে চাকরিতে যোগ দেয়। সে এখন এতো বুড়ো হয়েছে যে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে সর্বদা আকবরকে বাবর বলে সম্বোধন করে এবং এই মর্মে বিড়বিড় করে যে তিনি অনেক বদলে গেছেন। প্রধান অশ্ব বিশেষজ্ঞের (মাস্টার অফ হর্স) পদটিও তিনি পুনঃপ্রচলন করতে চান, এর দায়িত্ব হবে বিপুল সংখ্যক ঘোড়া ক্রয় করা, তার পরিকল্পনাধীন বিজয় অভিযান পরিচালনার জন্য।
আকবর জানতেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে যোগ্য লোক নির্বাচন করতে হবে। ঐ সকল পদের অধিকারীদের বিশেষ সুবিধা এবং মর্যাদা রয়েছে, আরো রয়েছে নানা প্রকার প্রলোভন। তিনি যাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ব্যাপারে আকবরের মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো না। হুমায়ূনের শাসন কালের প্রথম থেকেই মোগল পরিবারের প্রতি আহমেদ খান অকুণ্ঠ বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছে। এছাড়াও তিনি একজন বিচক্ষণ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। তিনি ভয়াবহ সকল লড়াই এবং নির্বাসনের বছর গুলিতে আকবরের পিতার অধীনে কাজ করেছেন এবং হিন্দুস্তান পুনঃবিজয়ের সময় কাবুল থেকে হুমায়ূনের সঙ্গে এক কাতারে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে আকবরের পক্ষে হিমুর বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। আহমেদ খানকে প্রধান সেনাপতির পদে নির্বাচন করা হলে আকবরের অন্যান্য সেনাপতিরা হয়তো হতাশ হবে কিন্তু কেউই তার যোগ্যতাকে অস্বীকার করবে না।