আমি কোনো অগ্রবর্তী রক্ষী পাঠাইনি। তাঁদের হুকুমকর্তা কে ছিলো?
আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার মনে হয় আমি শুনেছি একজন তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।
আকবরের মাথাটি বিস্ময়ের ধাক্কায় পিছিয়ে গেলো। তুমি কি তাদের কারো মুখ দেখেছো?
তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, এবং তাঁদের চোখের নিচের অংশ কাপড়ে ঢাকা ছিলো।
মেয়েটির গাল বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে এবং সে তা মোছার কোনো চেষ্টাই করছে না। কিন্তু ক্রোধ উন্মত্ত আকবর তখন আর মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন না। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। তিনি বললেন। কয়েক মিনিট পরে আকবরকে লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর দুধমার কক্ষের দিকে যেতে দেখা গেলো। ইশারায় মাহামের সেবিকাদের সরে যেতে বলে তিনি তীব্র ধাক্কায় দরজা খুলে তার কক্ষে প্রবেশ করলেন। মাহাম আঙ্গা একটি খাতায় কিছু লিখছিলেন। আকবরের অগ্নিমূর্তি দেখে তিনি দ্রুত সেটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন।
কি হয়েছে আকবর?
আপনার ছেলে কোথায়?
ওতো শিকারে গেছে। গত এক সপ্তাহ ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।
তাকে খুঁজে বের করুন-সে যেখানেই থাকুক-এবং তাকে বলবেন সে যেনো এই মুহূর্তে দরবারে ফিরে আসে?
নিশ্চয়ই বলবো। তোমার আদেশ তার জন্য শিরোধার্য। কিন্তু কেনো?
একটি মেয়ে, সে আমার হেরেমে নতুন এসেছে-আমার একজন নতুন মিত্র তাকে সম্মান এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছো-মেয়েটি অভিযোগ করেছে আদম খান তার দুই বোনকে অপহরণ করেছে।
মাহাম আঙ্গার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার পুত্র যদি এই অপরাধ করেও থাকে তিনি সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
অভিযোগটি অত্যন্ত ভয়াবহ, এবার আকবর অপেক্ষাকৃত ভদ্র ভাবে বললো। আমার দুধভাই অভিযোগের জবাব দিক। সে যদি নিরপরাধ হয় তাহলে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
নিশ্চয়ই। মাহাম আঙ্গা আকবরের হাত ধরলেন। কিন্তু আকবর, হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। আমার ছেলে কখনোই…. তার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেলো।
আমি আশা করছি আপনার ধারণাই যেনো সঠিক হয়। প্র
কৃতপক্ষে আদম খান এবং তার শিকারের সঙ্গীরা আকবরের আদেশ পেয়ে আগ্রায় ফেরার তিন দিন আগেই আকবর নিখোঁজ মেয়ে দুটির ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানতে পেরেছিলেন। এক উট চালক তার পশুকে যমুনা নদীতে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলে সে মৃতদেহ গুলিকে দেখতে পায়। দেহগুলি নগ্ন ছিলো এবং গলা কাটা ছিলো।
*
কি হয়েছে আকবর? তুমি এতো রাতে আমাকে ডেকেছো কেনো? এখনো আমি আমার সফরের কারণে ক্লান্ত এবং অপরিচ্ছন্ন।
আদম খান তোমার মনে আছে কীভাবে আমরা কাবুলের দুর্গের সম্মুখের তৃণভূমিতে তীর বেগে আমাদের টাটুঘোড়া ছুটাতাম?
নিশ্চয়ই মনে আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তুমি…।
সেটা ছিলো এক চমৎকার সময়। আমরা পরস্পরের কাছ থেকে কদাচিৎ বিচ্ছিন্ন হতাম। আকবর আদম খানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।
সেটাই তো একজন দুধভাইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত। আদম খান বললো।
সেটা তার চেয়েও বেশি। আমার নিজের কোনো ভাই বোন ছিলো না। তুমি না থাকলে আমি ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তাম। আর যখন আমার চাচারা আমাকে বাবা-মার কাছ থেকে অপহরণ করেছিলো, তখন তোমার মাই আমার একমাত্র রক্ষাকারিণী ছিলেন এবং তুমি নিজেও আমার সঙ্গে বন্দীত্ব বরণ করেছিলে। একই রকম কষ্ট ভোগ করেছে, একই বিপদ মোকাবেলা করেছো…এসব কারণেই আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করতে চাই তা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা আর অল্প বয়সী বালক নই এবং আমি এখন সম্রাট, তাই আমাকে প্রশ্নটা করতেই হবে।
তুমি কি বলতে চাও আকবর? আদম খানের হালকা বাদামি চোখ গুলি তার মায়ের মতোই-আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং সেগুলিতে তখন আর হালকা ভাব বজায় ছিলো না।
তিন দিন আগে এক বৃদ্ধ উট চালক যমুনা নদীতে ভেসে থাকা দুটি তরুণীর লাশ আবিষ্কার করে। সে মৃতদেহগুলিকে একটি লম্বা লাঠি দিয়ে টেনে পড়ে তোলে এবং কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। মৃতদেহগুলি তখন বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো।
আকবর জোর করে মৃতদেহগুলি দেখেছিলেন, চামড়া সরে যাওয়া দেহগুলি মাটিতে মাখামাখি হয়েছিলো। ইতোমধ্যে সেগুলিতে মাছি ভন ভন করছিলো। তাঁদের চোখ গুলি খোলা ছিলো যা শায়জাদার চোখের তুলনায় অনেক বেশি ফ্যাকাশে নীল। কাটা গলা রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিলো। আকবরের মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। আদম খান সামান্য মাথা নেড়ে বললো, শুনে আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু এর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?
ধৈর্য ধরো। আমি আমার হেকিমকে দেহ দুটি পরীক্ষা করতে বলি। সে আমাকে বলে গলা গুলি দক্ষভাবে গভীর করে কাটা হয়েছে–সম্ভবত ধারালো ছোরার সাহায্যে এবং তারা মারা গেছে দুই-তিন দিনের বেশি হয়নি। হেকিম আরো বলেছে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। আদম খান, তুমি কি জানো এই তরুণী গুলি কারা ছিলো?
আমি কীভাবে জানবো?
আকবর তার দুধভাই এর রুষ্ট চেহারা পর্যবেক্ষণ করলেন। তুমি নিশ্চিত যে তুমি জানো না?
অবশ্যই। ওদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তুমি কি আমাকে দায়ি করছো?
না। আমি কেবল জানতে চেয়েছি ওদের তুমি চিনতে কি না।
কিন্তু কেনো? কেউ হয়তো ষড়যন্ত্র করে আমাকে এর সঙ্গে জড়িয়েছে।
মৃত মেয়ে গুলির বোন শায়জাদা বলেছে আগ্রায় আসার পথে তাদের কাফেলাকে একদল মোগল সৈন্য থামায়। তারা তার বোনদের তুলে নিয়ে যায়। শায়জাদা শুনেছে তাদের একজন তাদের হুকুমকর্তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।