কিন্তু সেক্ষেত্রে আদম খান কার এতো ক্ষতি করেছে যার ফলে সে চিরকুট পাঠিয়ে তাকে আকবরের চোখে বৈরাম খানের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? যদিও তিনি বিশাল অঙ্কের পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন তবুও গত তিন মাসে বৈরাম খানের হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
যতোই দুর্বল বা অস্পষ্ট হোক ষড়যন্ত্রের আভাস আকবর উপেক্ষা করতে পারছিলেন না, কিন্তু তাঁকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। হিন্দুস্তানের বিপুল বিস্তৃত ভূ-খণ্ডের নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত রাজ্য সমূহের মধ্যে তথ্য চলাচলে বহু সময় লেগে যাচ্ছিলো। হয়তো আহমেদ খান এবং তার গুপ্তচরেরা শীঘ্রই কোনো সূত্র পেয়ে যাবে। হত্যাকরীদের খুঁজে বের করে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নেবেন না বলে মাকে কথা দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। মাকে রেশম কাপড়ে লেখা সতর্কবাণীটির কথা কি জানানো উচিত ছিলো? তিনি ভাবলেন। তিনি কয়েক বার তাঁকে জানাতে চেয়েছেন কিন্তু শেষপর্যন্ত বিরত হয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে এর ফলে তিনি আরো বিপর্যস্ত ও শঙ্কিত হবেন। তাছাড়া স্বভাবিক কারণেই এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকেও তিনি কিছু বলতে পারেননি…
*
মন্ত্রীসভার বৈঠক ভীষণ দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর মনে হচ্ছিলো। আকবরের মাথা ব্যাথা করছিলো এবং তিনি অবকাশযাপনকেন্দ্র নির্মাণ বা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাইছিলেন না। কিন্তু যখন তিনি সভাকক্ষ ত্যাগ করে হেরেমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তাঁর মন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। কয়েকদিন আগে ঝিলাম নদী পরবর্তী পাহাড়ী রাজ্য থেকে তাঁর এক নতুন মিত্র তাঁর হেরেম খানার জন্য কয়েকজন রক্ষিতা পাঠিয়েছে। দলটি তিন রাত আগে আগ্রায় পৌঁছেছে এবং এখন নিজের চোখে মেয়েগুলিকে দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। মায়ালার সঙ্গে তার প্রথম সলজ্জ ও আবেগতাড়িত মিলনের ঘটনাটি যেনো অন্য এক জীবনের কাহিনী। মায়ালা এখনো তাঁর প্রিয় কিন্তু তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে এমন আরো নারীর সন্ধান তিনি পেয়েছেন। হেরেমে পৌঁছে তিনি দরবারের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন। সম্মুখের সতেজ আনন্দ উপভোগের চিন্তায় তার চলার গতি দ্রুত হলো।
বৃদ্ধা হেরেম তদারককারিণী আকবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তাঁকে পথ দেখিয়ে সে একটি কক্ষে নিয়ে এলো। কক্ষটি আকর্ষণীয় রেশম কাপড় এবং রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করণে সাজানো। এসব সাজসজ্জাও তাঁর নতুন মিত্র পাঠিয়েছে। মেয়েগুলিকে আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তাঁরা আপনার সেবা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জাঁহাপনা। আপনাকে শুধু কষ্ট করে আপনার পছন্দের মেয়েটিকে বেছে নিতে হবে। বৃদ্ধাটি তালি বাজানোর সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী গুপ্তকুঠরির দরজা খুলে গেলো। বুকে একইরকম আটসাট কাঁচুলি এবং কোমরে মুক্তার ঝালর বাঁধা ঢোলা সালোয়ার পরিহিত তিনজন তরুণী কক্ষে প্রবেশ করলো। তাঁদের কালো চুলে মেহেদীর দীপ্তি, রত্নখচিত ক্লিপ দিয়ে তা মাথার পিছনে বাঁধা। তাঁদের মধ্যে দুজন লম্বা গড়নের এবং আকর্ষণীয় চেহারা বিশিষ্ট। তৃতীয় জন একটু খাট তবে কমনীয় গড়নের অধিকারী, তার চেহারায় রয়েছে নিখুঁত চমৎকারিত্ব। কিন্তু তার সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি কিছু আকবরের দৃষ্টি কাড়লো। সে ভীষণ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং শিকারীর উপস্থিতি টের পাওয়া হরিণের মতো দ্রুত শ্বাস ফেলছিলো। তার অসহায়ত্ব আকবরকে নাড়া দিলো এবং তাঁকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই-একথা মেয়েটিকে বোঝানোর জন্য আকবর তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করলেন।
এই মেয়েটি। আকবর বলে উঠলেন।
ওর নাম শায়জাদা। আপনি উত্তম পছন্দ করেছেন জাঁহাপনা। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিণী মন্তব্য করলো।
অন্য সকলে দয়া করে কক্ষ ত্যাগ করো, আকবর বললেন। তত্ত্বাবধানকারিণী যখন অন্য মেয়েগুলিকে নিয়ে চলে গেলো, আকবর দেখলেন শায়জাদার চোখে অশ্রু জ্বল জ্বল করছে। ভয় পেও না। তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে, আমাকে বলো। আমি কোনো নারীর উপর বল প্রয়োগ করি না।
আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি না জাহাপনা। মেয়েটি মোগলদের পুরানো ভাষা তুর্কীতে কথা বললো এবং তার উচ্চারণ আকবরের কাছে অপরিচিত লাগলো।
তাহলে কি হয়েছে? আকবর তার কাছে গেলেন, তার মুখের কমনীয় ডিম্বাকৃতি এবং চোখের দুস্পাপ্য নীলচে দ্যুতি তাঁকে একমুহূর্তের জন্য বৈরাম খানের কথা মনে করিয়ে দিলো। তাকে এতো বেদনাদায়ক সুন্দরী দেখাচ্ছিলো যে আকবরের তাকে ছুতে ইচ্ছা করলো।
মেয়েটি একটু ইতস্তত করলো, তারপর কথা বলে উঠলো। আমি যখন জানতে পারি আমাকে আপনার দরবারে পাঠান হবে তখন আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করি এবং খুশি হই। আমার বড় দুই বোনও।
একটু আগে তোমার সঙ্গে যে দুটি মেয়ে ছিলো তারা?
না, তারা আমার বোন নয়।
তাহলে তোমার বোনেরা কোথায়?
মেয়েটির মুখ শক্ত হয়ে এলো। আমাদের দলটি যখন আগ্রা থেকে দুই দিনের পথ দূরে ছিলো, একদল মোগল সৈন্য আমাদের পথ আটকায়। তারা বলে তারা আপনার পাঠানো অগ্রবর্তী রক্ষী, তাঁদের আপনি পাঠিয়েছে আমাদেরু পরিদর্শন করার জন্য এবং সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে তখনই আপনার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন বলে আমার দুই বোনকে তারা নিয়ে যায়। আমি আগ্রায় পৌঁছে আপনার হেরেম তত্ত্বাবধায়কের কাছে আমার বোনদের খোঁজ করি। কিন্তু তিনি বলেন তিনি অন্য কোনো মেয়ের খোঁজ জানেন না। দয়া করুন জাঁহাপনা, আমি আমার বোনদের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি…