কি ব্যাপার?
খারাপ খবর জাঁহাপনা। প্রায় চার সপ্তাহ আগে শিকার করতে বের হয়ে বৈরাম খান এবং তাঁর দশজন অনুচর আক্রান্ত হোন-তাঁর শিবির থেকে অল্প দূরে চম্বল নদীর তীরে।
বৈরাম খান কেমন আছেন? আকবরের মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছিলো। তিনি উত্তরটা অনুমান করতে পারছিলেন।
তিনি এবং তার শিকারের সঙ্গীরা সকলেই নিহত হয়েছেন জাঁহাপনা।
তুমি নিশ্চিত?
জ্বী। তাঁর শিবিরের রক্ষীরা নদীর পাশে নলখাগড়ার বোনে আধা লুকানো অবস্থায় তাদের মৃতদেহগুলি আবিষ্কার করে।
আমি নিজে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। কি ঘটেছিলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাকে জানতে হবে।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তারা এখন আগ্রার পথে রয়েছে জাহাপনা। তারা যে বার্তাবাহককে তাঁদের সম্মুখে প্রেরণ করেছিলো তার সঙ্গে আমার ধলপুরের অবকাশযাপন কেন্দ্রে দেখা হয়। আমার পরিচয় পেয়ে, যা ঘটেছে সবকিছু সে আমাকে বলে এবং আপনাকে দেয়ার জন্য এই চিঠিটা আমাকে দেয় যেটা বৈরাম খানের একজন কর্মকর্তা লিখেছে। দূতটি তার ধূলাময়লা যুক্ত সবুজ রঙের থলে থেকে একটি ভাজকরা কাগজ বের করলো।
আকবর যখন কাগজটির ভাঁজ খুললেন তখন ভেতরে থাকা রক্তের দাগযুক্ত আরেকটি ভাঁজ করা কাগজ মাটিতে পড়লো। আকবর সেটা তুললেন, তারপর প্রথম চিঠিটি দূতের হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে পড়ে শোনাও। দূতটি পড়া শুরু করলো, মাননীয় সম্রাট, অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি যে বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চম্বল নদীর তীরে তার এবং আমাদের অন্যান্য সাথীদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছি। সবাইকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়েছে। তবে বৈরাম খানের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আমরা মাথাটি খানিক দূরে পানির ধারে পাই। তাদের সকলের কাছ থেকে অলঙ্কার, অর্থ এবং অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছে। আক্রমণকারীরা কোনো দিকে গেছে জানার জন্য আমরা চিহ্ন ও আলামতো খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি। হয়তো তারা নৌকায় করে পালিয়েছে। আমি যে সংবাদ দিলাম তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ আরেকটি কাগজ পাঠাচ্ছি যেটা বৈরাম খানের দেহে পাওয়া গেছে।
আকবর ধীরে দ্বিতীয় চিঠিটা খুললেন। অন্য কারো তাকে এটা পড়ে শোনানোর দরকার ছিলো না। তিনি চিঠিটা চিনতে পেরেছেন-এটা তারই আদেশ যাতে মাহাম আঙ্গা বৈরাম খানের হজ্জ্বে যাওয়ার নির্দেশ লিখেছিলেন।
*
তিন ঘন্টা পর আকবর তার কক্ষের বারান্দা থেকে আগ্রার দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরকে উষ্ণ করা সূর্যের প্রথম রশ্মি ছড়িয়ে পড়তে দেখলেন। দৃশ্যটি তার মাঝে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করলো না। বরং তিনি এমনভাবে কাঁপছিলেন যেনো তার চারপাশের জগতটা বরফাবৃত। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বৈরাম খান মৃত। তিনি হত্যাকারীদের উপযুক্ত নৃশংস শাস্তি নিশ্চিত করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি নিজেও কি দোষী নন? তিনি যদি বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করতেন তাহলে হয়তো তিনি এখনো বেঁচে থাকতেন। আর তার মা কি বলবেন?
আকবর বৈরাম খানকে চাকরিচ্যুত করেছেন জেনে তিনি যতোটা রেগে গিয়েছিলেন তেমনটা আর কখনোও দেখা যায়নি। বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে এই ঘটনা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে? নিচের উঠানে পিতলের ঘন্টা বাজিয়ে রক্ষী তার পালা শেষ হওয়ার সংকেত দিলো। শীঘ্রই সূর্যটা দিগন্তের অনেক উপরে উঠে যাবে। হামিদা অন্য কারো কাছ থেকে খবরটা জানতে পারেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। যেমনটা বৈরাম খানের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার এখনি মায়ের কাছে যাওয়া উচিত। তিনি দ্রুত মুখে পানি ছিটিয়ে পরিচারকদের সাহায্য ছাড়াই পোষাক পড়ে নিলেন, তারপর হামিদার কক্ষের দিকে যাত্রা করলেন। যদিও তখন সবে মাত্র ভোর হয়েছে, হামিদা উঠে পড়েছেন। তার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আকবর বুঝতে পারলেন তিনি দেরি করে ফেলেছেন।
আমাকে ক্ষমা করো মা। তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমার বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত হয়নি। সেজন্য আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আকবর তার মায়ের রাগে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় থাকলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চুপ রইলেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ।
বৈরাম খান আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো ছিলেন। অবশেষে তিনি বললেন। তার মৃত্যুতে আমার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি খুন হওয়ার জন্য আমি তোমাকে দায়ি করছি না এবং তোমারও উচিত নয় নিজেকে দোষী ভাবা। তুমি তার: প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলে কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষতি হোক সেটা তুমি চাওনি, আমি তা জানি। আকবর… তিনি সরাসরি তাকালেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যতোটা সম্ভব সবকিছু জানার চেষ্টা করো। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করো-তারা সাধারণ ডাকাত, ভাড়াটে খুনী যেনো হোক-তাদের রক্তের বিনিময়েই তাদের অপরাধের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করো।
আমি তা করবো মা, শপথ করে বলছি। আকবর ছেলেমানুষের মতো আশা করলেন হামিদা হয়তো তাকে আলিঙ্গন করবেন, কিন্তু তার হাতগুলি দুপাশে স্থবির হয়ে রইলো। আকবর বুঝতে পারলেন তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আকবর তখনই তার কক্ষে ফিরলেন না। তিনি মুক্ত বাতাস এবং খোলা পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দুর্গের নিরাপত্তা পাঁচিলের উপর উঠে গেলেন। সকালের সূর্যের আলো পড়ে যমুনার জল স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে কিন্তু আকবরের মনের দৃশ্যপটে তখন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছবি ফুটে উঠেছে- তিনি বৈরাম খান এবং পিতার সঙ্গে বিজয়ীর বেশে দিল্লীতে প্রবেশ করছেন; পিতার সমাধির পাশে বৈরাম খান তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন; ইস্পাতের ধারালো ফলা ঝলসে উঠছে যখন বৈরাম খান তাঁকে চাতুর্যপূর্ণ পারসিক তলোয়ার চালনার কৌশল শিখাচ্ছেন, আকবরকে বার বার চেষ্টা করতে বলছেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারছেন; বৈরাম খানের নীলচে চোখে সন্তুষ্টির দৃষ্টি, যখন তিনি বন্দুক ছোঁড়া অনুশীলন করছেন।