তিনি দিল্লী থেকে ফিরে আসলে তাঁকে কথাটা বলতে পারতে, তাঁর ফেরার সময়তো প্রায় হয়ে এসেছিলো। তারচেয়েও খারাপ যেটা হয়েছে, কথাটা আমাকে সরাসরি বলার মতো সাহস না পেয়ে তুমি শিকার করতে চলে গেলে এবং আমি সবকিছু জানতে পারলাম স্বয়ং বৈরাম খানের পাঠানো চিঠি থেকে!
মায়ের বক্তেব্যের সত্যতায় আকবরের মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠলো। চিঠিটিতে নিজের সীলমোহর প্রদান করে সেটা তাঁর দূতের হাতে দিল্লীতে রওনা করিয়ে দিয়েই তিনি চার দিনের জন্য বাঘ শিকারে চলে যান। তাঁর এই সিদ্ধান্ত যদি সৎ হতো তাহলে মায়ের মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ইতস্তত করতেননা অথবা শিকারের নামে বাস্তবতা এড়াতে চাইতেন না। তবুও শিকার থেকে ফিরেই তিনি মাকে বলতে চেয়েছেন…কি বলবেন তা মনে মনে চর্চাও করেছেন। আসলে আগ্রা থেকে দিল্লী যাতায়াত করতে একজন দূতের যতোটা সময় লাগে সে সম্পর্কে তার হিসাব ভুল ছিলো। তাই শিকার থেকে ফিরে দেখেন হামিদা তাঁর কক্ষেই তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
বৈরাম খান কি লিখেছেন?
লিখেছেন কোনো রকম পূর্ব সতর্কবাণী বা ব্যাখ্যা ছাড়াই তুমি তাঁকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে এবং স্বয়ং আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে না পারার জন্য তিনি অনুতপ্ত। চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে আমি তাঁকে অনুরোধ করে উত্তর পাঠাই তিনি যেনো রাজধানীতে চলে আসেন। আমার পত্রবাহক তার নাগাল পায় যখন তিনি দিল্লী থেকে কয়েক দিনের পথ দূরে। তিনি কি উত্তর দিয়েছেন শোন। আবেগ কম্পিত কণ্ঠে তিনি পড়তে শুরু করলেন: ফিরে আসতে বলে আপনি আমার প্রতি অসীম উদারতা প্রদর্শন করেছেন সম্রাজ্ঞী, কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপনার পুত্র মহামান্য সম্রাট আমাকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আপনার স্বামীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত ছিলাম যিনি যুদ্ধে আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, আমি বর্তমান সম্রাটের প্রতিও অনুরূপ বিশ্বস্ত থাকতে চাই। আপনার পরিবারের উপর স্রষ্টার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এবং হিন্দুস্তানের বুকে তা আরো মহান হয়ে উঠুক এই কামনা করছি। বৈরাম খান একাধারে তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং উপদেষ্টা ছিলেন আকবর। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে তুমি তাকে অসম্মানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করলে?
আমি সর্বদাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমি প্রস্তুত-এবং তুমিও তাই। তিনি ফিরে এসে আমার সাফল্য দেখতে পাবেন এবং আমি তাকে আমার সভায় কোনো সম্মানিত পদে নিযুক্ত করবো। আকবর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন। কিন্তু বৈরাম খানকে তিনি যেভাবে চাকরিচ্যুত করেছেন সে ব্যাপারে তার মন এখন দ্বিধাবিভক্ত। তিনি কিছুতেই তার এই অনুভূতিকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। তিনি কি ভুল করেছেন? সম্ভবত জীবনে এই প্রথম তিনি তাঁর গ্রহণ করা কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজের মনের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হলেন। এখনো তার মা তাকে তিরস্কার করে চলেছেন।
তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। তুমি কীভাবে ভাবছো যে বৈরাম খানের মতো একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ তোমার হাতে আবারো নাজেহাল হওয়ার ঝুঁকি নেবেন? তিনি আর আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না এবং সেটা তোমার জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।
তখনো হামিদা কথা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু আকবর কল্পনায় মাহাম আঙ্গার মুখ দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত আস্থাভাজন এবং বৈরাম খানকে অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন…মা তার নেয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে দুর্বল করে ফেলছেন। মাকে এটা করতে দেয়া ঠিক হচ্ছেনা। বৈরাম খানকে আবার ফিরিয়ে আনলে শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়া তাঁর জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া গুরুজনদের উপদেশের প্রভাবে দ্বিধান্বিত হওয়া বা নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা একজন সম্রাটের জন্য মোটেই সমীচিন নয়।
আকবর অন্যদিকে তাকালেন। হামিদা একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন। তারপর ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তুমি একটা নির্বোধ।
*
একমাস পরের ঘটনা। আকবর ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে মায়ালার আরো নিকটবর্তী হলেন, তার উষ্ণ নগ্ন শরীর তার দেহের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। তারা দীর্ঘসময় ধরে তেজস্বী রতিকর্ম সম্পাদন করেছেন, এখন তার অচেতন দেহকে সেই তৃপ্তিই যেনো আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
জাঁহাপনা …জাহাপনা, উঠুন। কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে আকবর নিদ্রা আচ্ছন্ন চোখ মেলে হেরেম তদারককারিণীর কুঁচকান শুষ্ক মুখ দেখতে পেলেন।
কি হয়েছে? আকবরের হাত সহজাতভাবেই তার ছোরার খোঁজ করলো। সম্রাটকে হেরেমেও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
একজন দূত এসেছে, সে আহমেদ খানের লোক। সে বলছে সে যে সংবাদ এনেছে তা এই মুহূর্তে আপনার জানা প্রয়োজন।
ঠিক আছে। আকবর উঠলেন, তারপর তার শয়নকালীন ঢোলা জামা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চামড়ার চটি জোড়ায় পা গলালেন এবং বৃদ্ধাটিকে অনুসরণ করে হেরেমের দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরের প্রবেশ দ্বারের ভিতরে রক্ষীদের কাছ থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দূতটিকে তিনি চিনতে পারলেন। তাকে নোংরা এবং পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিলো কিন্তু আকবর বিচলিত হলেন তার মুখভাব দেখে।