খেদাড়েরা মোগলদের আদিনিবাস থেকে মধ্য-এশিয়ায় বয়ে আনা বহু পুরানো শিকারের কৌশল প্রয়োগ করছিলো। তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে অন্ধকার বনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো, আটশ জন লোকের তৈরি একমাইল প্রস্থের এক বিশাল বৃত্তের আকারে। সেই সাথে তারা পেতলের ঘন্টা এবং গলায় ঝোলানো সরু আকৃতির ঢোল পেটাচ্ছিলো। তারা বৃত্তটি ছোট করে আনতে শুরু করলো যার ফলে তাদের মানব-বেষ্ঠনী দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে বনের অন্যান্য জীবজন্তু যেমন-হরিণ, নীলগাই, বুনো-শূকর প্রভৃতি তাঁদের বৃত্তের কেন্দ্রে জড়ো হচ্ছিলো। একসময় বেড়ে উঠা আলোতে কয়েকজন খেদাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখলো এবং আকবরকে খবর পাঠালো যিনি তাঁদের পিছু পিছু হাতির পিঠে চড়ে আসছিলেন।
আকবর যে বিশাল হাতিটির পিঠে মণি-মাণিক্য খচিত হাওদায় বসে ছিলেন সেই জানোয়ারটিও বুঝতে পারছিলো বাঘটি কাছেই রয়েছে। বিপদের আশংঙ্কায় জানোয়ারটি তার বিরাট মাথাটি দুপাশে দোলাচ্ছিলো এবং বারবার শুড় গুটাচ্ছিলো। পেছনে যে হাতিগুলি আকবরের দেহরক্ষী ও পরিচারকদের বহন করছিলো সেগুলির বিশাল পায়ের অস্থির পদক্ষেপও তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। আকবর তাঁর হাতির ঘাড়ের উপর কায়দা করে বসে থাকা শীর্ণ দেহের লাল পাগড়ী পরা লোকটিকে ফিসফিস করে বললেন, মাহুত, হাতিটাকে শান্ত কর। মাহুত তৎক্ষণাৎ তার হাতে থাকা লোহার ঈষৎ বাঁকা দন্ড দিয়ে হাতিটির বাম কানের পিছনে টোকা দিলো। উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতিটি তার পরিচিত সংকেত পেয়ে ধীরে শান্ত হয়ে এলো এবং স্থিরভাবে দাঁড়ালো। পেছনের হাতিগুলিও সামনেরটিকে অনুসরণ করে স্থির ও নিশ্চল হয়ে দাঁড়ালো এবং চারদিক ভীষণ নিস্তবদ্ধ হয়ে পড়লো।
চমৎকার, আকবর ভাবলেন। এই মুহূর্তে তিনি নিজের মধ্যে চরম উদ্দীপনা অনুভব করলেন। তাঁর শিরায় রক্ত ছলকে উঠলো এবং তিনি নিজ হৃৎপিণ্ডের ধু ধু শব্দ শুনতে পেলেন, তবে সেটা ভয়ে নয় উত্তেজনায়। যদিও তাঁর বয়স এখনো চৌদ্দ পূর্ণ হয়নি, ইতোমধ্যেই তিনি অনেকগুলি বাঘ মেরেছেন। বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির খেলা, অনিশ্চয়তা ও বিপদের আশঙ্কা সর্বদাই তার মাঝে শিহরণ জাগিয়েছে। তিনি জানেন বাঘটি যদি আচমকা বেরিয়ে আসে, একমুহূর্তে তিনি পিঠে থাকা তূণীর থেকে তীর নিয়ে তাঁর দ্বি-বক্র ধনুকের ছিলায় পরিয়ে ফেলতে পারবেন-বেশিরভাগ শিকারী এধরনের পরিস্থিতিতে এই অস্ত্রই ব্যবহার করে। কিন্তু আকবরের জানতে কৌতূহল হচ্ছিলো তাঁর গাদাবন্দুকের সামর্থ কতোটুকু, বিশেষ করে এই কুখ্যাত বড় আকারের বাঘটার বিরুদ্ধে। গাদাবন্দুক ব্যবহারে তার নৈপুণ্যের বিষয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন এবং মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও লেখাপড়ার তুলনায় বন্দুক নিয়ে অনুশীলনেই অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন। বন্দুক ছোঁড়ার নৈপুণ্যে যদি তিনি তার সৈন্যদলের যে কোনো সৈনিককে পরাজিত করতে পারেন তাহলে অশিক্ষিত হওয়া কি দোষের? বাঘটির গর্জন থেমে গেছে এবং জানোয়ারটি তার বাদামী চোখে তাকে লক্ষ করছে বলে আকবর অনুভব করতে পারলেন। খুব ধীরে তিনি তাঁর ম্যাচলক মাস্কেট (গাদাবন্দুক) এর কারুকার্য খচিত ইস্পাতের নলটি তার আসনের পার্শ্বে নিচু করে ধরলেন। বন্দুকে গুলি ও বারুদ আগেই ভরে রেখেছেন, এখন এর ছোট পলিতাটি (ফিউজ, যাতে আগুন ধরিয়ে এই বন্দুকের গুলি ছুঁড়তে হয়। পরীক্ষা করলেন। তাঁর অনুচর তার পাশেই নিচু হয়ে পলিতায় অগ্নিসংযোগের জ্বলন্ত কাঠি ধরে রেখেছে।
সব ঠিক আছে নিশ্চিত হয়ে আকবর তার গাদাবন্দুকটি এ্যাকাসিয়ার জঙ্গলের সবচেয়ে ঘন ঝোঁপের দিকে তাক করলেন, তাঁর অনুমান বাঘটি ওখানেই লুকিয়ে আছে। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা বন্দুকের কাঠের বাটটি তার কাঁধে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলেন। অনুচরকে ফিসফিস করে বললেন, অগ্নিসংযোগের কাঠিটা দাও এবং খেদাড়েদের সংকেত দাও। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতির পিছনে অর্ধবৃত্তাকারে জড়ো হয়ে থাকা খেদাড়েরা উচ্চশব্দে চিৎকার করতে লাগলো এবং তাঁদের ঘন্টা ও ঢোলের তীব্র শব্দ তুললো। কয়েক মুহূর্ত পর যেনো প্রত্যুত্তর দিতেই বিকট গর্জন করে বাঘটি জঙ্গলের অন্ধকার চিড়ে বেরিয়ে এলো। বন্দুকের পলিতায় আগুন দেয়ার সময় আকবর বাঘটির বড় বড় সাদা দাঁত আর শরীরের সোনালী-কালো একটি ঝলক দেখতে পেলেন, ইতোমধ্যেই তাঁর হাতি লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিয়েছে। বিস্ফোরণের তীব্র আলো ঝলসে উঠলো, সেইসাথে কানে তালা দেয়া গুড়ম শব্দ। বন্দুকের বিস্ফোরণের ধাক্কায় উল্টো ডিগবাজি খেয়ে আকবর তার আসনের একপাশে ছিটকে পড়লেন কিন্তু তার আগমুহূর্তে বাঘটিকেও ধরাশায়ী হতে দেখলেন দশগজ দূরে। ধোঁয়া সরে গেলে আকবর দেখলেন জানোয়ারটি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে এবং সেটির ডান চোখের উপরে সৃষ্ট অমসৃণ ফুটো থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।
আকবর বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি মাহুতের সাহায্য ছাড়াই হাতিটির হাঁটুতে ভর দিয়ে মাটিতে নামলেন, তার মুখে তখন আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। তিনি চমৎকার দক্ষতায় বাঘটিকে হত্যা করেছেন। যারা সন্দেহ করতে গাদাবন্দুক এধরনের শিকার করার জন্য অত্যন্ত ধীর গতি সম্পন্ন, তাঁদের ধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণিত করলেন। একজন ভালো বন্দুকবাজের জন্য এই অস্ত্র যথেষ্ট দ্রুত কাজ করতে পারে। মৃত জানোয়ারটিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য তিনি এগিয়ে গেলেন। বাঘটির গোলাপি জ্বিহা সেটার মুখের একপাশে শিথিলভাবে নেতিয়ে আছে, তার উপর সবুজ-কালো বর্ণের মাছির দল ভন ভন করা শুরু করেছে। কিন্তু বাঘটির পেটে দুধের বাঁট লক্ষ্য করে তিনি অবাক হলেন। যে বাঘটিকে তিনি শিকার করতে এসেছেন সেটাতো পুরুষ হওয়ার কথা! এই ভাবনাকে অনুসরণ করে তার মনে যে ভাবনাটি এলো তার প্রতিক্রিয়ায় তার কিশোর বয়সী ঘাড়ের পিছনের চুলগুলি প্রায় দাঁড়িয়ে গেলো। তিনি কম্পিত আঙ্গুলে একঝটকায় কাঁধ থেকে ধনুক টেনে নিলেন এবং পিঠের তূণ থেকে একটি তীর ছিলায় পরানোর সময়ই বিশাল আকারের দ্বিতীয় বাঘটি আচমকা জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে সোজা তার দিকে এগিয়ে এলো। কোনোক্রমে আকবর তার তীরটি ছুঁড়তে পারলেন এবং সেইমুহূর্তে সময় যেনো তার কাছে স্থির হয়ে গেলো। তার পেছন থেকে আসা সতর্কতাসূচক চিৎকার ও কোলাহলো যেনো অস্পষ্ট হয়ে এলো এবং তাঁর মনে হলো এখানে তিনি এবং বাঘটি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি তাঁর ছোঁড়া তীরটিকে খুব ধীরে বাতাস চিড়ে ছুটে যেতে দেখলেন। তার মনে হলো লাফ দিতে উদ্যত বাঘটি স্থির হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ সময় যেনো আবার সচল হয়ে উঠলো এবং বাঘটি প্রায় তার উপর এসে পড়লো। আকবর লাফিয়ে একপাশে সরে গেলেন, তার চোখ প্রায় বন্ধ এবং তার মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে বাঘটির ধারালো নখ তার শরীরের মাংস চিরে ঢুকে যাবে এবং সেটার দুর্গন্ধযুক্ত মুখের ধারালো দাঁতগুলি তাঁর গলা কামড়ে ধরবে। পক্ষান্তরে ধুপ করে আছড়ে পড়ার শব্দে তিনি চোখ মেলে দেখলেন বাঘটি তার পাশে নিথর পড়ে আছে, তীরটি সেটার গলা এফোড় ওফোড় করে ঢুকে আছে। এক মুহূর্ত আকবর স্তব্ধ হয়ে রইলেন, অনুভব করলেন এটা এমন অভিজ্ঞতা যার সাক্ষাৎ তিনি আগে কখনোও পাননি-আতঙ্ক এবং সেইসঙ্গে ভাগ্যের সহায়তা। তখনো স্তম্ভিত, আকবর অগ্রসরমান ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেলেন এবং পিছন ফিরে দেখলেন। সরু ডালপালা ও ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে একজন অশ্বারোহী তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই শিবির থেকে আগত দূত, সন্দেহ নেই বৈরাম খান তাকে পাঠিয়েছেন তাগাদা দেবার জন্য। পাঁচ মিনিট আগে হলে এধরনের উৎপাতে তিনি বিরক্ত হতেন তার শিকারে বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু এখন তিনি কৃতজ্ঞবোধ করলেন একটু আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার পরিণতি বিষয়ে তার চিন্তায় ছেদ টানার জন্য। খেদাড়েদের দল, রক্ষী এবং সেবকরা দুপাশে সরে দূতকে পথ করে দিলো। তার সবল উঁচু ঘোড়াটি ঘামে ভিজে গেছে এবং সে নিজে ধূলার আস্তরণে এমনভাবে আচ্ছাদিত হয়েছে যে তার পরনের উজ্জ্বল সবুজ রঙ্গের মোগলাই উৰ্দিটি প্রায় খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। আকবরকে কুর্ণিশ করে সে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামলো, সংক্ষিপ্ত অভিবাদন শেষে এক নিঃশ্বাসে বললো, সম্রাট, বৈরাম খান অনুরোধ করেছেন আপনি যেনো এক্ষুণি শিবিরে ফেরেন।