আমি বিশ্বাস করতে পারছি না বৈরাম খান এধরনের কাজ করতে পারেন। হয়তো এটাকে তিনি চুরি মনে করছেন না। হয়তো তিনি ভাবছেন এটা তার ন্যায্য অধিকার। তিনি চার বছর ধরে তোমার অভিভাবকত্ব করছেন এবং ক্ষমতা মানুষের উপর বিস্ময়কর প্রভাব ফেলে আকবর।
কিন্তু তিনি গোপনে হারটি নিলেন কেনো? নির্দোষ রক্ষীদের ভোগান্তিতে ফেললেন কেনো?
খুব ভালো প্রশ্ন করেছো আকবর।
আকবর এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। মাহাম আঙ্গার তাঁকে মিথ্যা কথা বলার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আকবর বৈরাম খানের ব্যাপারে দুর্ভাবনায় ছিলেন বলেই তিনি তাঁকে গল্পটা বললেন। এটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছিলো যে বৈরাম খান ক্ষমতার প্রতি এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত উপরি সুবিধাগুলির প্রতি ক্রমশঃ আসক্ত হয়ে পড়ছিলেন। আকবর মনস্থির করে ফেললেন। মাহাম আঙ্গা, আপনি আমাকে যা বললেন তার ফলে আমি এ ব্যাপারে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছি যে বৈরাম খানের প্রভাব থেকে আমার নিজেকে মুক্ত করতে হবে।
সম্রাটের প্রতি এই ধরনের প্রতারণা যদি তোমার পিতামহের আমলে ঘটতো তাহলে দোষী ব্যক্তিকে এর জন্য জীবন দিতে হতো।
কি বললেন? আকবর বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। না, সে ধরনের কোনো চিন্তাই আমি করবো না। আমি আমার সবকিছুর জন্য বৈরাম খানের কাছে ঋণী এবং আমি এখনো আমার জীবন বাজি রেখে তাকে বিশ্বাস করি। যতোই দামি হোক না কেনো, ঐ হীরার হারটির জন্য আমি তার প্রতি মোটেই অসন্তুষ্ট নই। কিন্তু আমাকে তার নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাকে একাই সাম্রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।
মনে হলো মাহাম আঙ্গা একমুহূর্ত কিছু ভাবলেন। তাহলে তাই হোক…তোমার পিতা যখন তোমার বিশ্বাসঘাতক চাচাঁদের প্রভাব থেকে নিজকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তখন তিনি তাদেরকে মক্কায় তীর্থ যাত্রায় পাঠিয়েছিলেন। বৈরাম খান এখন দিল্লীতে, সেখানে তিনি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরিদর্শন করছেন তাই না? তাঁর কাছে একটা চিঠি পাঠাও। বলো তোমার স্বার্থ রক্ষায় তার বিশ্বস্ত অবদানের জন্য তুমি তার প্রতি কতোটা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি সাম্রাজ্যের সেবা করতে গিয়ে নিজে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন দেখে তুমি ভীষণ উদগ্রীব। বলল তোমার ইচ্ছা তিনি যাতে হজ্জ্ব পালন করেন, কারণ এর ফলে তার শরীর ও মন প্রশান্তি লাভ করবে। তাছাড়া তিনি যাতে এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করেন যাকে সুসংহত করার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। তুমি সম্রাট। তোমার এই আদেশ সে পালন করতে বাধ্য।
আকবর একটি গাঢ় কমলা রঙের রেশমের কোলবালিশে হেলান দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। বৈরাম খানকে বিতাড়িত করার জন্য মাহাম আঙ্গার এই পরামর্শ নিঃসন্দেহে উত্তম। হজ্জ্ব পালন করতে তাঁর প্রায় একবছর লেগে যাবে। স্থল পথে গুজরাট গিয়ে সেখান থেকে জাহাজে চড়ে আরব দেশে পৌঁছাতে হবে। তারপর দীর্ঘ মরুপথ পারি দিয়ে তাকে মক্কায় পৌঁছাতে হবে। যখন তিনি ফিরে আসবেন তততদিনে নিশ্চয়ই আকবর সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারবেন। তখন তিনি তাঁর পরামর্শদাতা সাবেক অভিভাবককে কোনো সমৃদ্ধ রাজ্য নির্বাচন করে সেখানে আরামদায়ক অবসরে পাঠাতে পারবেন।
কিন্তু একই সময়ে আকবরের মস্তিষ্কের আরেকটি অংশ তাঁকে বললো এই পরিকল্পনা খুবই অসম্মানজনক। তাঁর নিজের দিল্লীতে গিয়ে সামনাসামনি বৈরাম খানকে তাঁর অনুভূতির কথা বলাটাই যুক্তিসঙ্গত। তবে ইতোমধ্যে তিনি এধরনের চেষ্টা অনেকবারই করেছেন। সর্বদাই বৈরাম খান কথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন এবং কৌশলে তাঁর ইচ্ছাকে দমন করেছেন। তার মোকাবেলা করার জন্য তিনি যদি মায়ের সমর্থন পেতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটতো। কিন্তু হামিদা তার অনুভূতি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন….অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো…হয়তো এখন সময় হয়েছে মাকে এবং বৈরাম খানকে বোঝানোর, যে তিনি বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি নিজেই এখন চিন্তা করতে পারেন এবং কর্ম সম্পাদন করতে পারেন।
মাহাম আঙ্গা, আমার পত্র লেখকের ভূমিকাটি আপনিই পালন করুন এবং এতোক্ষণ যা বললেন তা লিখুন বৈরাম খানকে। সেই সঙ্গে এটাও যুক্ত করবেন যে আমি তাকে সর্বদাই সম্মান করবো…তিনি আমার কাছে একজন পিতার মতোন।
নিশ্চয়ই। আকবর দেখলেন মাহাম আঙ্গা একটি পিতল দিয়ে বাঁধানো নিচু গোলাপ কাঠের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে একটি কালির দোয়াত এবং ময়ূরের পালক রাখা ছিলো। তিনি টেবিলের সামনে হাঁটুমুড়ে বসলেন। একটি কাগজ টেনে নিয়ে মোমের কম্পিত আলোয় তিনি চিঠি লেখা শুরু করলেন যেটিকে আকবর নিজের মুক্তির সনদ বলে মনে করছেন। আকবর অনুভব করলেন সবকথা সঠিকভাবে লেখার ব্যাপারে তিনি তাকে বিশ্বাস করতে পারেন।
১.২ উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা
০৪. উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা
বৈরাম খানের সাথে কীভাবে এতো অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করলে! হামিদা আকবরের কাঁধ আকড়ে ধরলেন। কে তোমাকে এই বুদ্ধি দিলো? কেউ না। আকবর এবিষয়ে মাহাম আঙ্গার ভূমিকা প্রকাশ করতে চাইলেন না। তিনি তাঁর ইচ্ছাকেই রূপ দিয়েছেন এবং আগে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা তার নিজেরই ছিলো। সেই মুহূর্তে আকবরের মনে হলো হামিদা তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেবেন। তিনি তাকে কখনোই এতো ক্রুদ্ধ হতে দেখেননি।