রাগ করোনা আকবর। আমি কেবল তোমার মঙ্গলের জন্যই এসব কথা বললোম। আমি তোমার জন্য গর্বিত এবং তুমি একদিন একজন মহান সম্রাট হবে। সব ধরনের অস্ত্রে তুমি পারদর্শী। তোমার চেয়ে দক্ষ কোনো ঘোড়সওয়ার, কুস্তিগির, তীরন্দাজ অথবা তলোয়ারবাজ নেই। তুমি নির্ভীক এবং উদার মনের অধিকারী। প্রজাদের ভালোবাসা অর্জনের যোগ্যতা তোমার আছে। কিন্তু তোমাকে ধৈর্যের শিক্ষা নিতে হবে এবং তোমার নিকটবর্তী সেই সব মানুষের সঙ্গে সতর্কভাবে বোঝাঁপড়া করতে হবে যারা তোমার ইচ্ছার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে মাথা নত করে না। আর সবকিছুর উপরে তোমাকে স্মরণ রাখতে হবে তোমার জীবনে আগত যাবতীয় মঙ্গলের জন্য তোমার কাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।
আকবর নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন যখন তার মা এগিয়ে এসে তার কপাল চুম্বন করলেন। মা তাকে অমনোযোগী এবং অকৃজ্ঞ বলছেন এই বোধ তাঁর মাঝে হতাশা এবং ক্রোধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁকে চিন্তাহীন আরাম-সন্ধানী মনে করেন। তিনি কি সত্যিই এমন একজন তরুণ যে অসময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছাড়াই? তার মেধা সম্পর্কেও মা কটাক্ষ করলেন। বৈরাম খানও তার প্রতি অনুরূপ মনোভাব পোষণ করেন। সজোরে দরজা খুলে বের হয়ে তিনি দ্রুত নিজের কক্ষে চলে গেলেন। মায়ের কথায় তাঁর অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয় কিন্তু তিনি কিছুতেই নিজের ভাবাবেগ সামলাতে পারছেন না। মা কেনো তাকে বুঝলেন না? তিনি তাকে সম্পূর্ণ অপদস্থ করেছেন।
তিনি তখনো গভীবভাবে চিন্তামগ্ন একটু পরে যখন তাঁর পরিচারক তার কক্ষে প্রবেশ করলো।
কি ব্যাপার?
মাহাম আঙ্গা আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।
তাঁর দুধমা আবার তাকে কি বলতে চায়? রুক্ষমুখে আকবর ভাবলেন মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময়। মা কি তাকে আকবরকে সংযমী এবং ধৈর্যশীল হওয়ার উপদেশ দিতে বলেছেন? যদি তাই হয় তাহলে তিনি বৈঠক সংক্ষিপ্ত করবেন-এই মুহূর্তে তিনি আর কোনো বক্তৃতা শুনতে প্রস্তুত নন। কিন্তু মাহাম আঙ্গা যখন আকবরকে সম্ভাষণ জানালেন তখন তার মুখে আকবরের প্রতি শুধুমাত্র ভালোবাসা এবং দুর্ভাবনার আভাস দেখা গেলো।
আমি লক্ষ করেছি ইদানিং তুমি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকছে। আমার পরিচারিকা বলেছে কিছুক্ষণ আগে কুদ্ধভাবে তুমি তোমার মায়ের কক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। আকবর, কি সমস্যা হয়েছে? তার স্বচ্ছ বাদামি চোখ আকবরের চোখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং তাঁর কণ্ঠস্বর তেমনই কোমল আর মিষ্টি যেমনটা আকবর শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি সর্বদাই তাঁর কথা শ্রবণ করেছেন, তাঁকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। আকবর নতুন উদ্যমে তাঁর ক্ষোভের কাহিনী বর্ণনা করতে শুরু করলেন। মাহাম আঙ্গা গভীর মনোযোগে কোনো ব্যাঘাত না ঘটিয়ে সম্পূর্ণটা শ্রবণ করলেন। আকবর যখন নিরব হলেন মাহাম আঙ্গা প্রশ্ন করলেন, তোমার মা এসব শুনে কি বললেন?
ধৈর্যধারণ করতে।
তিনি ঠিকই বলেছেন। তাড়াহুড়া করে কিছু করা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয় এবং তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার আছে।
তাঁর দুধমা তার মাকে সমর্থন করতে যাচ্ছেন, আকবর ভাবলেন।
এই জন্যই আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। আমার নিজের মাঝেও দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি তুমি শাসন করার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু বৈরাম খান-একজন মহান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও সেটা স্বীকার করতে চাইছেন না। তিনি তার হাতে থাকা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছেন না।
আমার পিতার মৃত্যুর পর শুধু নামে ছাড়া আর সবক্ষেত্রেই তিনি সম্রাটের ভূমিকা পালন করছেন… আকবর দ্রুত বলে যাচ্ছেন। এখন তিনি ভাবছেন তার ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছু বললে তিনি অসন্তুষ্ট হোন-যেমন আগ্রাকে রাজধানী করতে চাইলে তিনি এর বিরোধীতা করেন।
হয়তো সত্যিই তিনি নিজেকে সম্রাট ভাবছেন। আমি শুনেছি তিনি তাঁর অনুগামীদের মধ্য থেকে রাজপদের জন্য তোক নিয়োগ করেন তোমার অনুমতি ছাড়াই। আমি আরও জেনেছি, তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো, ইদানিং তিনি একজন সম্রাটের চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। আকবর, একটা বিষয় তোমার জানা দরকার, কিন্তু তোমাকে শপথ করতে হবে যে এই কথা আমি তোমাকে বলেছি সেটা তুমি কাউকে বলবে না।
নিশ্চয়ই বলবো না। বৈরাম খানের সম্রাটের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগের বিষয়টা বুঝিয়ে বলুন।
আমি জেনেছি রাজকীয় কোষাগার থেকে সম্পদ আত্মসাৎ করে তিনি নিজের ভাণ্ডার ভরছেন। বিশেষ করে তিনি একটি মহামূল্যবান ময়ূর আকৃতির রত্নখচিত হীরার হার আত্মসাৎ করেছেন যেটা হিমুর কোষাগারে ছিলো। পানি পথের বিজয়ের পর হিমুর উজির তার প্রভুর মালিকানাধীন মূল্যবান সম্পদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। সেই তালিকায় এই হারটির উল্লেখ ছিলো। কিন্তু তোমার সেনাকর্তাদের কেউ হারটি পায়নি। ফলে হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত সম্পদের পাহারায় নিয়োজিত সৈন্যদের শাস্তি মূলক চাবুকপেটা করা হয় অবহেলার দোষারোপ করে।
আপনি নিশ্চিত যে বৈরাম খানই হারটি নিয়েছেন?
হ্যাঁ। প্রথমে আমি এই গল্প বিশ্বাস করিনি-কারণ রাজপ্রাসাদে কতোরকম ভিত্তিহীন গুজবই না প্রচলিত থাকে, বিশেষ করে হেরেমে গালগল্প ছাড়া আর তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু কিছু সপ্তাহ আগে তোমার দুধভাই আমাকে বলে সে এমন একটা গল্প জানে-যা শুনে আমি মজা পাবো। সে আমাকে একজন রক্ষিতার কথা বলে যে অল্প কিছুদিন আগে বৈরাম খানের হেরেমে ছিলো এবং নিজের চোখে হারটি দেখেছে। অবশ্যই সে সেটা পড়েছে। আমার ধারণা বৈরাম খান বিশেষ মুহূর্তে তাঁর প্রিয় নারীটির নগ্ন দেহে হারটি পড়া দেখতে ভালোবাসেন। আদম খান গল্পটির তাৎপর্য বুঝতে পারেনি- সে মনে করেছে বৈরাম খানের এই গোপন স্বভাবের কথা জানতে পেরে আমি হাসবো। আমিও তাকে কিছু বলিনি এবং সে ধারণা করতে পারেনি যে হারটির বর্ণনা শুনে আমি সেটাকে চিনতে পেরেছি।