আকবরের জীবন কাহিনী এবং তার কীর্তি বর্ণনা করা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। সেজন্য আমি (লেখক) যেসব স্থানে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলাম-বাস্তবিক অর্থে দুইবার পরিদর্শন করতে হয়েছে। সে সব স্থান আকবরের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আগ্রাতে আমি আকবরের সুন্দর বাগানে বসেছিলাম, শেষ বিকালের সূর্য অস্তমিত হচ্ছে, সেই সময় বাগানের রূপ আরো মোহময় হয়ে ফুটে উঠেছে। হাঁটতে হাঁটতে হুমায়ুনের সমাধিস্থলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই সমাধিস্থল সুন্দরভাবে তৈরি করেছিলেন আকবর। বাবার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন। কীর্তিগাথা এই সমাধিস্থল একেবারে দেখতে যেনো তাজমহলের মতো। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত এই সমাধিস্থলও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। আগ্রাতে যখন ছিলাম প্রচণ্ড তাপমাত্রায় হাঁটাচলা করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিলো, আর এজন্যই মনে হয় এই অঞ্চলের মানুষ উটের পিঠে করে চলাচল করে। উট হচ্ছে তাদের প্রধান যানবাহন, এই কাজটি আকবর কর্তৃক সম্পন্ন হয়েছে। মূলত যুদ্ধের সময় প্রয়োজনীয় পানি এবং খাদ্য সরবরাহ হতো এই উটের গাড়িতেই। উপরন্ত এই উটের বিশাল বহর দেখেই শক্তি ও ক্ষমতার প্রকাশ ফুটে উঠতো। ঝরোকা বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে একটা কথাই ভাবছিলাম–আকবর প্রতিটি বিষয় কীভাবে যাচাই বাছাই করে মূল্যায়ন করতেন। তিনি নিখুঁতভাবে নিজেকে প্রদর্শিত করতেন আর এই রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর কূলে বসতেন তিনি।
আকবরের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং আত্মবিশ্বাস যা এই ফতেহপুর শিক্রির সুন্দর বাগান অবারিত সুখের সৃষ্টি করেছে। অথচ তিনিই এই বালুময় শহর ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। রাজ প্রাসাদের চারপাশে সুরম্য অট্টালিকা, মনোরম স্থান এবং আনন্দ উপভোগের জন্য হেরেমখানা তৈরি করেছেন। তবে এতো প্রাচীন এই রাজপ্রাসাদে কোনো অশরীরী আত্মা বা ভূত প্রেত নেই, হেরেমখানা এবং রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে নীল টালি দ্বারা আবৃত, ছাদ তৈরি হয়েছে ধূসর রঙ দিয়ে। আকবরের সময় নারীরা জানালার পাশে বসে থেকে তাদের দিনাতিপাত করতো। হেরেমখানার নারীদের কথা ভিন্ন।
আকরব নিজের তৈরি সুইমিং পুল অনূপতালাও এ বসে প্রকৃতির প্রেম-ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করতেন। প্রচন্ড গরম, শুস্ক আবহাওয়া এবং মরু অঞ্চল তবুও এই সুইমিং পুলে বসে শরীর মন সতেজ করতেন আকবর। পুলের পাশেই শেখ সেলিম চিশতির মসজিদ এবং সেখানে মানুষ নামাজ আদায় করতে যায়। মসজিদটি সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি।
রাজস্থানে অম্বর এবং জোদপুরের বিধ্বস্ত রাজপ্রাসাদ-তাদের বর্ণানুযায়ী আকবরের ইচ্ছা ছিলো ঐ গোষ্ঠীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার, রাজপুত গোষ্ঠীকে তার মিত্রবাহিনী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চত্তিরগড়ের রাজপুত উপলব্ধি করলেন আকবর তাদের সাম্রাজ্যে আঘাত হানতে যাচ্ছে তখন তারা সতর্ক হলেন। আকবরের রাজ প্রাসাদে পূর্ব দিক থেকে উপরে উঠছিলাম-সম্রাট আকবর নিজেও তার সৈন্য বাহিনীকে পূর্ব দিক থেকে উপরে উঠতে বলতেন। এর কারণ শত্রুপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করা সম্ভব। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পাথরের চিহ্ন দিয়ে একটি স্থান সংকুলান করে রাখা আছে, যা দিয়া বুঝানো হতো যে মোগলদের পরাজয় হতে পারে না। একই সাথে রাজপুত নারীরা নিজেদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলো, তারা যুদ্ধের সময় মশাল জ্বালিয়ে রাখতো, মোগলদের কর্তৃক পতন বা নির্যাতিত হওয়ার থেকে এই মশালের আগুনে পুড়ে মরে যাওয়া উত্তম মনে করতো তারা। একথা স্মরণযোগ্য যে, তার আমলে সমসময় অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল, নম্র আচরণ করা হতো। একই সময়ে এই মোগল সম্রাট তার শাসনামলে যতো সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছেন–তা ইতিহাসে বিরল। তিনি প্রতিপক্ষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেন।
মোগল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন নিয়ে যতো বই, দলিল-পত্র উপস্থাপিত হয়েছে তাতে রয়েছে সামরিক শাসন, তাদের ঔদ্ধত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শাসন ক্ষমতা দখল। এ সবকিছুই রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড বইতে তুলে ধরা হয়েছে। আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ খুবই নাটকীয়। শ্বেত পাথরে নির্মিত রাজ প্রাসাদের বেলকনিতে সম্রাট হুমায়ুন প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গিয়াছিলেন। তারপর তিনি যখন প্রাসাদের নিচে নামতে যান তখন সিঁড়িতে তার সুন্দর জুতায় ধাক্কা লাগে এবং পায়ে আঘাত পেয়ে একেবারে নিচে পড়ে যান। তার শরীর রক্তাক্ত হয়। বহু হাকিম বৈদ্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। কিন্তু এই পর্যায়ে কোনো কাজ হয়নি। তিনি পরলোক গমন করেন। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর ফলে তার স্ত্রী হামিদা খান চিন্তিত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আশংকা করেন। কারণ সে সময় আকবরের বয়স ১৩ বছর। এ সময় বৈরাম খান পরামর্শ দেন হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর কাউকে জানানো যাবে না। এজন্য তারা পাথরের বেলকোনিতে এমন একজনকে দাঁড় করিয়ে রাখতো যা দূর থেকে হুমায়ুনের মতোই মনে হতো, কেউই বুঝতে পারত না যে হুমায়ুন মারা গেছে।
আকবরের দুগ্ধ ভ্রাতা আদম খান তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তারই হেরেমখানায়। আকবর তার প্রতিপক্ষ হিমু এবং তার বাহিনীকে রাজস্থান, গুজরাট, বাংলা, কাশ্মির, সিন্ধু এবং দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধে পরাজিত করে। ম্রাট আকবর বহু বিবাহ করেন এবং তার শতাধিক রক্ষিতা ছিলো। তার অনেক স্ত্রীর নামই কেউ কখনো জানতে পারেনি। জানা সম্ভবও ছিলো না। আকবরের জীবন এতোটাই সমৃদ্ধ ছিলো যে-তার পঞ্চাশ বছরের শাসনামলে যতো ঘটনা ঘটেছে তা এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আর ঐতিহাসিকদের কাছে থেকেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে এমনটা বলা যাবে না। এমন অনেক ঘটনা আছে যা বর্ণিত হয়নি।