এক ঘন্টা পরের ঘটনা, জাহাঙ্গীর এপ্রিলের উজ্জ্বল সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে চোখ পিট পিট করছে। তার মস্তিষ্কটি এখনো অনেক হালকা বলে অনুভূত হচ্ছে। যেনো সে আকণ্ঠ সুরা পান করেছে কিম্বা অপিয়াম সেবন করেছে। কিন্তু সুলায়মান বেগকে তার দিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে এগিয়ে আসতে দেখে মনের হালকা চপলতাকে সে ঠেলে সরিয়ে দিলো।
কি ব্যাপার?
বিশ্বাসঘাতকতা, জাঁহাপনা!
কি বলছো তুমি? কার এতো বড় সাহস…?
আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র। আপনি জানেন, তিন দিন আগে যুবরাজ খোসরু আগ্রাদুর্গ ত্যাগ করেছেন?
নিশ্চয়ই জানি। সে আমাকে বলেছে কিছু দিনের জন্য সে সিকান্দ্রায় যেতে চায় এবং সেখানে বাবার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ তদারক করতে চায়। স্থপতিদের কি নির্দেশনা প্রদান করতে হবে তাও আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। সিকান্দ্রায় যাওয়া কখনোই তার উদ্দেশ্য ছিলো না। তিনি উত্তরে লাহোরের দিতে অগ্রসর হচ্ছেন। পথে তার সমর্থকরা তার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে এবং তিনি আরো বেশি লোককে ঘুষ দিয়ে দলে টানছেন। তিনি অবশ্যই কয়েক সপ্তাহ আগে সমস্ত পরিকল্পনা করেছেন। আজিজ কোকা তার সঙ্গে আছে। আমি এ সব জানতে পেরেছি কারণ আজিজ কোকা আপনার স্ত্রীর ভাই মান সিংকে তাদের বিদ্রোহে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং আমাকে এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা অবহিত করেন।
জাহাঙ্গীর সুলায়মান বেগের কথাগুলি আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো না। তার মনে তখন দ্রুত বেগে ভাবনা চলছে। চেষ্টা করলে আমরা তাদের পিছনে ফেলে অগ্রসর হতে পারি। আমার একদল দ্রুতগামী অশ্বারোহী যোদ্ধাকে প্রস্তুত করো। আমি নিজে তাঁদের নেতৃত্ব দেবো। আমি বহু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আমার প্রাপ্য অধিকার অর্জন করতে পেরেছি। সেই অধিকার আমি কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবো না। যে আমার বিরুদ্ধাচারণ করবে তাকে রক্তের বিনিময়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে, সে যেই হোক না কেনো…
*
ঐতিহাসিক নোট
মহান মোগল সম্রাটদের নিয়ে আলোচনা করতে হলে সাধারণত মানুষ আকবরকে নিয়েই সার্বিক পর্যালোচনা করে। একথা সত্য এবং দৃঢ়তার সাথে বলা যায় তিনি হচ্ছেন প্রথম মোগল সম্রাট যার জন্ম এই হিন্দুস্তানে। তাঁর জীবন খুবই বিচিত্র। দীর্ঘ শাসনামলে এই মহান সম্রাট যেমন ছিলেন সফল তেমনভাবে তিনি তার সাম্রাজ্য এতোটাই প্রসারিত করেছিলেন যে ভারতীয় উপমহাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ করায়ত্ব করে ফেলেন। শুধু তাই নয় এই ভারত বর্ষের লক্ষ লক্ষ প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ধর্মের মূলবাণী নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। বাবা হুমায়নের শাসনামলের শেষ ভাগে তার সাম্রাজ্যের কিছু অংশ শাহ্জাদা আকবরের নামে উপহার দেন।
আকবরের সাফল্য এতোটাই বিস্তৃত হয়েছিলো যে তার পরবর্তী বংশধর ও প্রজন্ম তার ভূলত্রুটিগুলো গোপন রেখে বরং তার কীর্তিগাথা কাহিনী শুধু হিন্দুস্তানেই নয় সারা ভারতবর্ষে প্রচার করেছে। আকবরের কাজের ধারাবাহিকতা ছিলো নিখুঁত এবং অনন্য। তাঁর গুণ, মহত্ব ও কাজ সম্পর্কে বিস্ত রিত জানা যায় আবুল ফজলের আকবর নামা এবং আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ থেকে। এই দুটি গ্রন্থ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে–যা প্রায় চার হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত। এই দুটি গ্রন্থে আকবরের শাসনামলের পূর্ণ ও বিস্তারিত বর্ণনা সুন্দর ও নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আকবরের শাসনামলের ঐতিহ্য, ক্ষমতা এবং সাংস্কৃতিক মিলনের যে সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে তাই তুলে ধরা হয়েছে আবুল ফজলের আকবর নামা গ্রন্থে। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এবং নিজের বাস্তব উপলব্ধি থেকে আবুল ফজল তার গ্রন্থে শুধু এটাই বর্ণনা করেন নি-যে কীভাবে সম্রাট আকবর তার শত্রুকে পরাস্থ করেছেন, তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছেন। সেই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন-মান কতোটা উন্নত করেছেন সেই ব্যাপারেও বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। নিত্যপণ্যের দাম সর্বদা সাধারণ মানুষের সহনশীল পর্যায়ে রাখতেন। দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য তার বিশাল রাজপ্রাসাদে প্রতিনিয়ত খাবারের আয়োজন করা হতো। রান্না-বান্না হতো সারা দিন-রাত, হারাম-হালাল খাবারের জন্য অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হতো। ১৬০২ সালে আবুল ফজল খুন হলে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন আসাদ বেগ। ঐ ব্যক্তিই আবুল ফজলকে সার্বিক সহায়তা করতেন, তিনি আকবরের জীবনের শেষ পরিণতির সময়ে গ্রন্থের পান্ডুলিপি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।
ভিকায়া গ্রন্থে আকবরের জীবনের শেষ দিককার সব কাহিনী তুলে ধরেন তিনি। আকবরের তীব্র সমালোচক বাদাউনী, মুনতাখাব আল-তারিখ-গ্রন্থে আকবরের জীবনের শেষ অংশে কি করুণ পরিণতি হয়েছিলো সেই অগণিত কথা বর্ণনা করেছেন।
আকবরের শাসনামলে ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটতে থাকে। ব্যবসায়ী, ধর্ম প্রচারক এবং নিজের ভাগ্য উন্নতির জন্য বহু শ্রমিক ও পেশাজীবী মানুষ এই মোগল সাম্রাজ্যের দিকে ছুটতে থাকে। মহা মিলনমেলা রচিত হয়। ধর্ম প্রচারক ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরাট অন্যতম প্রধান ধর্ম প্রচারক–যিনি আকবরের শাসনামলে প্রথম ভারত বর্ষ ভ্রমণ করেন। তিনি কমিউনিটি অন হিজ জার্নি টু দা কোর্ট অব আকবর প্রবন্ধে তার ধর্ম সম্পর্কে যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিলো তা মানুষকে অবহিত করেন। আকবরের ইবাদত খানায় সব ধর্মের মানুষ মুক্ত আলোচনা করতো। রালফ ফিটস নামের একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী যিনি ১৮৫৪ খ্রি. প্রথম হিন্দুস্তানে এসে আগ্রা এবং ফতেহপুর শিক্রির বিস্ময়কর সৃষ্টি দেখে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেন।