সেলিম তার মনকে টেনে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো, তারপর আবার তার বক্তব্য শুরু করলো। আমি একটি নতুন নাম নির্বাচন করেছি যে নামে আমি আপনাদের সম্রাট হিসেবে পরিচিতি পেতে চাই। সেটা হলো জাহাঙ্গীর, এর অর্থ পৃথিবীর অধীশ্বর। আমি এই নাম গ্রহণ করলোম কারণ সম্রাটদের দায়িত্ব তাদের নিয়তিকে জয় করা এবং জগৎকে পরিচালনা করা। আমার পিতা আমাকে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য দিয়ে গেছেন। আপনারা, আমার বিশ্বস্ত প্রজাগণ, আপনাদের সহায়তায় আমি এই সাম্রাজ্যকে আরো অধিক শক্তিশালী করতে চাই।
সেলিম সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো এবং তার বাহু দুটি দুদিকে প্রসারিত করলো, যেনো দরবার কক্ষে উপস্থিত সকলকে সে আলিঙ্গন করছে। সেই মুহূর্তে সমগ্ৰ কক্ষ জুড়ে একটি বাক্য ধ্বনিত হতে থাকল জাহাঙ্গীর দীর্ঘজীবি হোক! সেই ধ্বনি সেলিমের কানে বড়ই মধুর মনে হলো।
*
তোমরা এখন যেতে পারো, জাহাঙ্গীর তার কোষাধ্যক্ষ এবং পরিচারকদের আদেশ দিলো যারা তার সঙ্গে দীর্ঘ সিঁড়ি পথ বেয়ে লোহামোড়ান কাঠের দরজা বিশিষ্ট কোষাগার পর্যন্ত এসেছে। কোষাগারটি আগ্রাদুর্গের কোনো একটি আস্তাবলের নিচের গোপন জায়গায় অবস্থিত।
আপনি যখন আদেশ করেছেন আমরা নিশ্চয়ই চলে যাবো জাহাপনা। কিন্তু আলো জ্বালা না হলে কোষাগারের এই নিচ্ছিদ্র কক্ষটি সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে এবং এর মেঝে অত্যন্ত পিচ্ছিল।
তোমার চাবিটি আমাকে দাও এবং আমাকে একটি মশালও দিয়ে যাও। আমি একাই ভিতরে ঢুকতে চাই।
কোষাধ্যক্ষ চামড়ার ফালিতে বাধা একটি জটিল নকশার লোহার চাবি জাহাঙ্গীরের কাছে হস্তান্তর করলো এবং একজন পরিচারক তার হাতে একটি জ্বলন্ত মশাল দিলো। সকলের অপসৃয়মান পদশব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর অপেক্ষা করলো এবং সেঁতসেঁতে, মাটির গন্ধ যুক্ত পাতাল সুরঙ্গে একা হয়ে পড়লো। সে এখনো নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা যে বর্তমানে সে সীমাহীন ধনদৌলতের মালিক। রাজকীয় রত্নের যে তালিকা কোষাধ্যক্ষ তার জন্য প্রস্তুত করেছে তাতে প্রায় একশ আটান্ন কেজি ওজনের হীরা, মুক্তা, চুনি(ঘন লাল বর্ণের রত্ন) এবং পান্নার উল্লেখ রয়েছে। ছয় লক্ষ পঁচিশ হাজার রতির বেশি মহামূল্যবান রত্ন রয়েছে জাহাপনা, কোষাধ্যক্ষ তার দক্ষ আঙ্গুলের সাহায্যে সেলিমকে তালিকাটির একটি জায়গা নির্দেশ করে দেখানোর সময় বলেছিলো। এবং স্বল্পমূল্য রত্নে সংখ্যা এতো বেশি যে তা গণনা করা সম্ভব নয়, তাছাড়া সোনা এবং রুপার মোহর তো রয়েছেই।
যদিও বিষয়টি কিছুটা ছেলেমানুষী পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু জাহাঙ্গীর তার যে কোনো একটি কোষাগার পরিদর্শন করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলো। সে সযত্নে তেল দেয়া মজবুত তালাটির ফুটোয় চাবি ঢুকিয়ে ঘোরালো, তারপর ধাক্কা দিয়ে ভারী দরজাটি খুলে মশালটি উঁচু করে ধরে ভেতরে উঁকি মারলো। কক্ষটি ভীষণ অন্ধকার ছিলো, কিন্তু জাহাঙ্গীর সেখানে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে মশালের আলোতে কিছু একটা ঝলসে উঠলো। সে মশালটি আরো উঁচু করে ধরলো এবং দেখতে পেলো দরজার বাম পাশের দেয়ালের সারিবদ্ধ কোটরে তেলের প্রদীপ রাখা আছে। সে মশালের আগুনের সাহায্যে প্রদীপগুলি প্রজ্জ্বলিত করে একটি মোমদানের ভিতর মশালটি গুঁজে দিলো। তারপর চারদিকে তাকালো। জাহাঙ্গীর যা অনুমান করেছিলো তার তুলনায় কক্ষটি বেশ বড় লম্বায় প্রায় ত্রিশ ফুট এবং সেটার ছাদ কক্ষটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সুদর্শন দুটি বালুপাথরের থামের উপর ভর দিয়ে আছে।
তবে যে জিনিস গুলি জাহাঙ্গীরে দৃষ্টি কাড়লো সেগুলি হলো চারটি বিশাল আকারের গম্বুজাকৃতির ঢাকনা বিশিষ্ট বাক্স। সেগুলি কক্ষের শেষ প্রান্তের দেয়ালের কাছে কাঠের কাঠামোর উপর স্থাপিত রয়েছে। ধীরে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে সে একটি বাক্সের ঢাকনা উন্মুক্ত করলো। সেটার ভিতর প্রায় হাসের ডিমের সমান আকারের রক্তলাল চুনি দেখতে পেল। সেগুলির এক মুঠো হাতে নিয়ে তার দিকে তাকালো। কতোই না চককার এই রত্নের রাণী নামে খ্যাত রত্ন গুলি। এক মুহূর্তের জন্য মেহেরুন্নেসার মুখটি তার মনে পড়লো যখন তার নেকাবটি ছুটে গিয়েছিলো। এই চুনি গুলি তাকে ভীষণ মানাবে এবং এখন যখন সে সম্রাট, সে তার পছন্দের যে কাউকে রত্ন উপহার দিতে পারে…যে কাউকে তার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করতে পারে…রত্নগুলি রেখে দিয়ে ঢাকনা আটকে সে আবার অগ্রসর হলো। পরের বাক্সটি বিভিন্ন আকারের গাঢ় সবুজ বর্ণের পান্নায় পরিপূর্ণ। সেগুলির কোনোটি কাটা হয়েছে কোনোটা অকর্তিত রয়েছে। পরের বাক্সটিতে রয়েছে নীলা এবং হীরা। পৃথিবীতে একমাত্র দাক্ষিণাত্যের গোলকোন্দার খনি গুলিতেই এই রত্ন পাওয়া যায়। চতুর্থ বক্সটি মুক্তায় ভরা। জাহাঙ্গীর মুক্তাগুলির মাঝে তার কনুই পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিলো এবং তার ত্বকে সেগুলির প্রলুব্ধকর শীতলতা অনুভব করলো।
জাহাঙ্গীর এই বাক্সগুলির ডান দিকে একাধিক খোলা বস্তার মধ্যে প্রবাল, টোপাজ, টোরকুইজ, অ্যামিথিস্ট এবং অন্যান্য স্বল্পমূল্যের পাথর অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলো। শুধুমাত্র এগুলি দিয়েই একটি সেনাবাহিনীর এক বছরের অর্থসংস্থান করা সম্ভব…হঠাৎ সে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। এই কোষাগারে যা রয়েছে তা তার মোট সম্পদের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র- দিল্লী বা লাহোরের কোষাগারের তুলনায় এটুকু কিছুই নয়, কোষাধ্যক্ষ তাকে জানিয়েছে। হাসতে হাসতেই জাহাঙ্গীর মেঝে থেকে একটি বস্তা তুলে নিয়ে তার উপাদান মেঝেতে উপুর করে ঢেলে দিলো, তারপর আরেকটি, তারপর আরেকটি, বিভিন্ন রঙের পাথর গুলি নির্বিচারে খিচুড়ি পাকিয়ে ফেললো। সেগুলি বিশাল একটি স্কুপে পরিণত হওয়ার পর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং একপাশ থেকে অন্য পাশে গড়াতে লাগলো। সে এখন মহামান্য সম্রাট। একজন হিন্দু ঋষি লিখে গেছেন যে, কারো মনের সবচেয়ে আকাঙ্খিত বাসনাটি পূরণ হওয়ার মতো হতাশা জনক আর কিছুই নয়। জাহাঙ্গীর অনুভব করছে ঋষিটির মতামত ভুল ছিলো। সে একমুঠো রত্ন ছাদের দিকে ছুঁড়ে মারলো এবং প্রদীপের আলোতে সেগুলি জোনাকি পোকার মতো তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।