সেলিম দেখলো আকবরের মুখ ব্যথায় কুঁচকে উঠলো, সেটা পেটের ব্যথার জন্য হতে পারে অথবা তার আচরণের স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়ার কারণেও হতে পারে। সে বলে উঠলো, আমি আমার সন্তানদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিবেচনা করার চেষ্টা করবো, কিন্তু ইতোমধ্যেই আমি উপলব্ধি করা শুরু করেছি সেটা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
তোমাদের মধ্যে কে উপযুক্ত উত্তরাধিকারী হতে পারে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে আমি একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছি যা কারো জন্যেই মঙ্গল বয়ে আনেনি। কিন্তু আমি যদি এমনটা নাও করতাম, সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে এই বাস্তবতাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতো যে পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক কখনোই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। একজন পিতা তার পুত্রকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করে। কিন্তু পুত্র তার পিতার প্রতিটি কর্মকাণ্ডকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখে। পিতা যে দায়িত্ব সন্তানের উপর অর্পণ করে তাতে সে অসন্তুষ্ট হয় এবং স্বাধীন ভাবে সবকিছু করার চেষ্টা করে। সে মনে করতে থাকে তার সকল ব্যর্থতা, ত্রুটি এবং নৈরাশ্যের জন্য তার পিতাই দায়ী এবং তার সকল সাফল্য এবং সৎগুণাবলীর জনক সে নিজে। সে এটাও বিশ্বাস করতে থাকে যে সুযোগ পেলে সে তার পিতার তুলনায় অধিক সফল হতো।
আমি তোমার বক্তব্য এখন স্পষ্টই বুঝতে পারছি, সেলিম স্বীকার করলো, বর্তমানে আমার সন্তানরাও বড় হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি তোমার বিরল এবং মহান কৃতিতু গুলির জন্য তোমার প্রতি শ্রদ্ধাও অনুভব করেছি। সেই সব বৈশিষ্ট্যের জন্য নিজেকে তোমার তুলনায় তুচ্ছও মনে হয়েছে। যে কষ্ট আমি তোমাকে দিয়েছি তার জন্য আমি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত।
এবং আমি তোমাকে যে কষ্ট প্রদান করেছি সেজন্য আমিও দুঃখিত। কিন্তু আমি তোমাকে বর্তমানে একটিই অনুরোধ করবো। অতীত থেকে শিক্ষা নাও কিন্তু তাকাও ভবিষ্যতের দিকে। কথা বলতে বলতে আকবর তার শীর্ণ হাতটি সেলিমের দিকে বাড়িয়ে দিলেন এবং সেলিম তা নিজের হাতের মাঝে জড়িয়ে ধরলো। শৈশবের পর এই প্রথম তার মনে হলো সে তার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করছে, সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করার জন্য তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে।
*
স্থান আগ্রা দুর্গের দরবার কক্ষ। ধীর লয়ে বেজে চলা নাকাড়ার(একপ্রকার ঢাক) শব্দের সঙ্গে সেলিম মার্বেল পাথরের মঞ্চের ধাপ পেরিয়ে তার জন্য অপেক্ষারত সিংহাসনটির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার আঙ্গুলে তৈমুরের ব্যাঘ প্রতীক বিশিষ্ট আংটিটি শোভা পাচ্ছে। নয় দিন আগে সেটি তার মৃত পিতার আঙ্গুল থেকে কোমল ভাবে খুলে নিয়ে সে নিজের আঙ্গুলে পড়েছিলো। ঈগলের হাতল বিশিষ্ট আলমগীর তার কোমরের পাশে ঝুলছে। গলায় তিন স্তর বিশিষ্ট অকর্তিত পান্না এবং মুক্তা শোভিত মালা যেটি একসময় তার প্রপিতামহ বাবরের ছিলো। একটি বীরত্বপূর্ণ অতীতের ধারাবাহিকতার অনুভূতি সেলিমের হৃদয়কে গর্বে ভরে তুলেছে। সেলিমের মনে হচ্ছিলো তার সভাসদ এবং সেনাপতিদের মধ্যে তার পূর্ব পুরুষেরাও উপস্থিত রয়েছেন এবং তারা তার সিংহাসনে আরোহণ প্রত্যক্ষ করছেন, যেই মসনদের জন্য তারা বহু লড়াই করেছেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং তাকে ভবিষ্যতে আরো নতুন বিজয় অর্জনের জন্য অনুরোধ করছেন।
সেলিম সিংহাসনের সোনারুপার কারুকাজখচিত সবুজ গদিতে আসন গ্রহণ করলো এবং সেটার রত্নখচিত সোনার হতলের উপর তার বাহু দুটি স্থাপন করলো। আমার শ্রদ্ধেয় পিতার মৃত্যুর কারণে আমি নয় দিন শোক পালন করেছি, তার দেহটি এখন তার প্রিয় সিকান্দ্রার বাগানে শায়িত আছে। সেখানে আমি তার মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করবো। মসজিদ গুলিতে গত শুক্রবারে আমার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে এবং এখন সময় হয়েছে আপনাদের নতুন সম্রাট হিসেবে নিজেকে আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করার।
সেলিম থামলো এবং তার সম্মুখে একাধিক সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের উপর নজর বুলালো, নিজ পিতাকে বহুবার সে এমনটা করতে দেখেছে। তার বর্তমান আসনটি থেকে সমগ্র পৃথিবীটাকে অন্য রকম মনে হচ্ছে। যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে কেবল তাদের ভাগ্যই নয় বরং সমগ্র সাম্রাজ্যের শত কোটি মানুষের ভাগ্য এখন তার অধীনস্থ। এটা একটি সীমাহীন, প্রায় ঈশ্বরপ্রতীম দায়িত্ব এবং উৎসাহব্যঞ্জকও। সেলিম তার মেরুদণ্ডটি আরো সোজা করে বসলো। তখন তার সঙ্গে সুলায়মান বেগের চোখাচোখি হলো, সে লম্বা চওড়া দেহের অধিকারী আব্দুল রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার দুধভাই এর মুখে ফুটে থাকা মৃদু হাসি দেখে সে বুঝতে পারলো সেও তার বর্তমান অনুভূতি কিছুটা আঁচ করতে পারছে।
সেলিম তার পুত্রদের দিকে তাকালো, তারা মঞ্চের ঠিক নিচে তার ডান পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে। আঠারো বছর বয়সী খোসরুকে তার বেগুনি রেশমের জোব্বা এবং হীরক ঝলসানো পাগড়িতে চমৎকার দেখাচ্ছে। খোসরুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তেরো বছর বয়সী খুররম, তার শীর্ণ মুখটিতে শোকের ছায়া ফুটে আছে, আকবরের মৃত্যু তাকে যতোটা গভীর ভাবে শোকার্ত করেছে সম্ভবত পরিবারের আর কাউকে ততোটা করেনি। ষোল বছর বয়সী পারভেজ তাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা তিনজনই সুস্থ্য সবল সুন্দর তরুণ, কিন্তু খোসরুর উপরই সেলিমের দৃষ্টি বেশিক্ষণ নিবদ্ধ রইলো। তার অস্থির উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য তাকে ক্ষমা করতে হবে এবং তার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় বের করতে হবে। তার সঙ্গে আন্তরিক হওয়ার কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই রয়েছে এবং খোসরুর মাঝে সৃষ্টি হওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা জনিত হতাশা, ঈর্ষা এবং অনিশ্চয়তার ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করতে হবে যা আকবরের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ক্ষত্রিস্ত করেছিলো।