অনুগত পুত্রের মতো সেলিম তার বাবার পাশে গিয়ে বসলো। সে বসার পর আকবর বলতে লাগলেন, আহমেদ মালিক বলেছে শীঘ্রই আমি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো।
আমি প্রর্থনা করি এতো শীঘ্রই যেনো এমন কিছু না ঘটে, সেলিম বললো, অনুভব করলো এই কথাগুলি সে মন থেকে বলেছে। এতোদিন পরে যখন বহুপ্রতীক্ষিত রাজমুকুটটি তার অধিকারে এসে গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিকে সে আরো উদার চিত্তে গ্রহণ করার সামর্থ অর্জন করেছে। তার বাবার কৃতিত্বের সঙ্গে সে, কি নিজেকে তুলনা করতে পারে? সেলিম আবার বলে উঠল, কিন্তু সত্যিই যদি তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাহলে আমি অনুরোধ করবো সেই আনন্দ এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে তুমি পৃথিবী থেকে বিদায় নাও যে তোমার মতো মহান কৃতিত্ব অর্জনকারী সম্রাট পৃথিবীতে কদাচিৎ জন্ম নেয়।
একজন ইউরোপীয় ধর্মযাজক আমাকে একবার বলেছিলো তাদের খ্রিস্টিয় ধর্মবিশ্বাসের গোড়া পত্তনের শত বছর পূর্বে একজন দার্শনিক জন্ম নিয়েছিলেন যিনি মৃত্যু সম্পর্কে অত্যন্ত সুন্দর একটি মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন একজন মানুষকে সত্যিকার অর্থে সুখি বলা যাবে না যদি না সে শন্তিতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় করার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকা কালীন সময়ে আমি ঐ দার্শনিকটির বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেয়েছি। আমি সেভাবেই এই সাম্রাজ্যকে সুগঠিত করার চেষ্টা করেছি যাতে আমার মৃত্যুর পরে এর সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত না হয়ে। এখন যখন আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে আমি শান্তিতে দেহত্যাগ করতে পিরবো যদি তুমি আমার কিছু বিদায়কালীন উপদেশ সত্যিকার গুরুত্ব সহকারে শ্রবণ করো।
নিশ্চয়ই বাবা। মাত্র কিছু সময় আগে তুমি যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে তোমার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করলে তখন এই বিশাল দায়িত্ব আমাকে আস্থার সঙ্গে প্রদান করায় আমি একাধারে আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ বোধ করেছি।
প্রথমত, সর্বদা মনে রাখবে সাম্রাজ্যকে কখনোও স্থবির হতে দিলে চলবে না। অপরাপর ঘটনা প্রবাহ দ্বারা যদি এর সমৃদ্ধি এবং পরিবর্তন সাধিত না হয় তাহলে তা ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হবে।
আমি বুঝতে পেরেছি। আমি দাক্ষিণাত্যের সেনা অভিযান অব্যাহত রাখব। আমাদের সাম্রাজ্যের উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত নদী এবং পাহাড় দ্বারা সুরক্ষিত। বর্তমানে দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করাই আমদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং ফলপ্রসূ উদ্যোগ হবে।
দ্বিতীয়ত, সর্বদা বিদ্রোহ মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। এক মুহূর্তের জন্য সেলিমের মনে হলো বাবা তাকে এখনোও তিরস্কার করছেন কি না। কিন্তু তিনি যখন তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন তখন সে সেরকম কোনো ইঙ্গিত পেলো না, আমার একজন ইতিহাসবিদ আমাকে জানিয়েছে আমি আমার শাসনামলে একশ পঞ্চাশটি বিদ্রোহ দমন করেছি। তখনই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে যখন সেনাবাহিনীর যুদ্ধাভিযান অথবা লুটের মালামাল প্রাপ্তির সুযোগ রহিত হয়েছে যা তাদের ষড়যন্ত্র করা থেকে বিরত রাখতে পারতো।
সেলিম মাথা ঝাঁকালো।
সকলের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করবে, তাদের মর্যাদা বা ধর্ম যাই হোক না কেনো এবং সর্বদা ক্ষমা প্রদর্শন করবে যদি সম্ভব হয়। এর ফলে প্রজাদের মাঝে ঐক্য বজায় থাকবে। কিন্তু তোমার ক্ষমাকে যখন দুর্বলতা ভাবা হবে অথবা কোনো গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হবে, নির্দয় ভাবে চূড়ান্ত আঘাত হানবে যাতে তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে সকলে অবহিত হতে পারে। আমার বাবা হুমায়ূন যে সব ভুল করেছিলেন সেগুলি এড়িয়ে চলবে। উদাহরণ সৃষ্টির জন্য আগেই অল্প মানুষের মৃত্যু হওয়া ভাল পরবর্তীতে অনেক বেশি প্রাণহানির তুলনায়।
আমি যখন কাউকে আক্রমণ করবো তখন কোনো দুর্বলতা প্রদর্শন করবো না বরং সুচিন্তিত এবং দৃঢ় ভাবে আগ্রাসন চালাবো, সেলিম প্রায় যান্ত্রিক ভাবে বললো। পিতার বক্তব্য সে স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছে এবং তা নতুন কিছু নয়। হয়তো আকবর তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নিজেরই প্রশংসা করছেন সেলিমকে সহায়তা মূলক উপদেশ প্রদানের পরিবর্তে। কিন্তু তখন, সেলিমের মনোভাব বুঝতে পেরেই যেনো, আকবর বললেন, আমি আমার ভুল গুলি থেকে শিক্ষা নিয়েই কঠিন পথে বাস্তব সম্মত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
সেলিমের দেহ সামান্য আন্দোলিত হলো। এই প্রথম সে শুনলো তার পিতা নিজের ভুল ত্রুটি সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করছেন।
তোমার পরিবারের প্রতি মনোযোগ প্রদান করবে। বর্তমানে আমাদের সাম্রাজ্য যতোটা শক্তিশালী তাতে বাইরের শত্রুর কাছ থেকে আক্রমণের আশংকা তুলনামূলক ভাবে কম। আভ্যন্তরীণ কলহ বিবাদই বর্তমানে আমাদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। আমার বাবা তার সম্ভাইদের অতিরিক্ত প্রশ্রয় প্রদান করেছিলেন। কিন্তু আমি এই বাস্তবতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি যে ক্ষমতা কখনোও ভাগাভাগি করা যায় না এবং আমার কর্তৃতুই চূড়ান্ত। আমি এখনোও বিশ্বাস করি সেটা সত্যি- এক শাসনামলে একজনই শাসন করতে পারে। যাইহোক, তুমি এবং তোমার ভাইয়েরা যখন বড় হলে, আমি আশা করলোম তোমাদের মাঝে আমার গুণাবলী গুলি বিকশিত হবে এবং প্রশ্নাতীত ভাবে তোমরা আমার নির্দেশনা মেনে চলবে। কিন্তু তোমাদের মাঝে আমি আমার আশার প্রতিফলন দেখতে পেলাম না। তবে একথা সত্যি যে, যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে আমিও হয়তো তাঁর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করতাম অথবা স্বাধীন ক্ষমতা দাবি করতাম।