জাঁহাপনা, আপনার প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমিও মাননীয় হাসান আমলের সঙ্গে একমত পোষণ করছি, আব্দুল রহমান নরম সুরে তার মতামত পেশ করলো। তার আশেপাশে উপস্থিত সকলে মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন করছিলো কিন্তু সেলিম সামান্য একটি সংকেত পাওয়ার জন্য তার বাবার মুখের দিতে চেয়ে রইলো। আকবরের চোখ গুলি বর্তমানে আধবোজা হয়ে আছে এবং সেলিমের আশংকা হলো তিনি হয়তো অচেতন হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তখনোই সম্রাট তার একটি হাত তুললেন।
হাসান আমল এবং আব্দুল রহমান, তোমাদের বিচক্ষণতার জন্য আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, এর আগেও তোমরা বহুবার তোমাদের বিজ্ঞতার প্রমাণ রেখেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষ তোমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করছে। অবশ্য তারা সেটাই সমর্থন করছে যা আমি মনে মনে ঠিক করেছি। আমার পরিচারকরা রাজ পাগড়ি এবং জোব্বা নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।
নিজের অজান্তেই সেলিমের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো এবং নিজেকে শান্ত রাখার জন্য সে লড়াই করতে লাগলো। তারপর পিতার দিকে তাকাল যখন তিনি আবার তার বক্তব্য শুরু করলেন, এখন শুরু মাওলানাদের ডাকা বাকি রয়েছে। আমি চাই তারাও প্রত্যক্ষ করুক যে আমি যুবরাজ সেলিমকে আমার উত্তরসূরি নির্বাচন করেছি।
যখন উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সেলিমের উপর নিবদ্ধ হলো, একটি অসহনীয় ভারী বোঝা তার বুকের উপর থেকে নেমে গেলো। অবশেষে শাসন ক্ষমতা তার উপর বর্তালো এবং নিয়তির বিধান পূর্ণ হলো। তার মুখমণ্ডল খুশিতে উদ্ভাসিত হলো কিন্তু সেই সঙ্গে চোখ দুটি অশ্রুতে ভরে উঠলো যখন সে কথা বললো, ধন্যবাদ বাবা, আমি আমার উপর আপনার অস্থার মর্যাদা রক্ষা করবো। যখন সময় উপস্থিত হবে তখন সকলের সমর্থন আমার প্রয়োজন হবে এবং আমি সকলের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করবো।
বিশ মিনিট পরে, উপস্থিত সভাসদ এবং ওলামা পরিষদের সম্মুখে, আব্দুল রহমান সেলিমের মাথায় সবুজ রেশমের রাজকীয় পাগড়িটি পড়িয়ে দিলো এবং হাসান আমল রাজকীয় আলখাল্লাটি দিয়ে সেলিমকে আচ্ছাদিত করলো। আকবর কয়েক মুহূর্ত তাঁর পুত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, তোমাদের সকলের সামনে আমি সেলিমকে পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করছি যে আমার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করবে। আমি তোমাদের সকলকে আদেশ করছি তার প্রতি তোমাদের আনুগত্য প্রদর্শন করতে, তোমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ যাই হোক না কেনো। এখন আমি তোমাদের সকলের মুখ থেকে সেই শপথ বাক্য শ্রবণ করতে চাই।
দরবার কক্ষে উপস্থিত সকলে সমস্বরে আকবরের বক্তব্যে সাড়া প্রদান করে সেলিমের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করলো। এমনকি আজিজ কোকাও তাতে যোগ দিলো।
আমার আরেকটি কর্তব্য পালন করা বাকি রয়ে গেছে। আকবর সিংহাসনের আচ্ছাদনের নিচে হাত ঢুকালেন এবং কম্পিত হস্তে রত্নখচিত খাপ এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী তলোয়াটি বের করে আনলেন। এটা সেই আলমগীর, যে তলোয়ারের সাহায্যে আমার দাদা বাবর তার শত্রুদের নির্বাপিত করেছিলেন এবং একটি সাম্রাজ্য জয় করেছিলেন। বহুবার এটি আমার নিজের জীবন রক্ষা করেছে এবং আমাকে বিজয় এনে দিয়েছে। সেলিম এটি আমি তোমার কাছে হস্তান্তর করছি। কখনোও এর মর্যাদা রক্ষা করার যোগ্যতা হারিও না।
যখন সেলিম তলোয়ারটি গ্রহণ করার জন্য তার বাবার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসলো, ঈগলের চুনিখচিত চোখ গুলি ঝলসে উঠলো। শেখ সেলিম চিশতি সত্যের চেয়ে একটুও বেশি কিছু বলেননি। অবশেষে সেই মোগল সম্রাটের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলো।
*
সেইদিন কয়েক ঘন্টা পর, আকবরের প্রধান হেকিম আহমেদ মালিক সেলিমের কক্ষে এলো। তার চেহারা অত্যন্ত গম্ভীর। আপনার বাবার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। তবে তার মস্তিষ্ক পরিষ্কার রয়েছে। তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর আয়ু আর কদিন রয়েছে। আমরা তাকে বলতে বাধ্য হয়েছি যে আমাদের পক্ষে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো ধারণা দেয়া সম্ভব নয়, তবে এই টুকু বলা সম্ভব যে তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। হয়তো কয়েক দিন অথবা আরো কয়েক ঘন্টা। তিনি এক দুই মিনিট কিছু বললেন না। তারপর তিনি শান্তভাবে আমাদের সতোর জন্য ধন্যবাদ দিলেন এবং এতোদিন আমরা তার জন্য যা করেছি এবং তাকে আরাম প্রদানের জন্য এখনোও যা করছি তার জন্য। এরপর তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমি এক্ষুনি যাচ্ছি, সেলিম বললো। কয়েক মিনিট পরে সূর্যালোকিত উঠান পেরিয়ে সেলিম তার পিতার শয়নকক্ষের দিকে অগ্রসর হলো। উঠানের কেন্দ্রে জল উদগিরন্দরত মার্বেল পাথরের ফোয়ারার সৌন্দর্য তার দৃষ্টি কাড়লো না। পিতার কক্ষের বাইরে অবস্থানরত দেহরক্ষীরা সেলিমের প্রবেশের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দিলো। চন্দনকাঠের সুঘ্রাণ বা আগরবাতিদানে প্রজ্জ্বলিত কর্পূরের গন্ধ কোনো কিছুতেই আকবরের পচনশীল পরিপাকতন্ত্রের কটু গন্ধকে আচ্ছাদিত করা সম্ভব হয়নি।
সম্রাট কিছু বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। আকবরের চেহারা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, চোখের নিচে সৃষ্টি হওয়া ভাঁজগুলি বেগুনি বর্ণ ধারণ করেছে। তা সত্ত্বেও তিনি শান্ত স্থির দৃষ্টিতে পুত্রের দিকে তাকালেন এবং মুখের কাছে ধরে থাকা পানির পাত্রে একটি চুমুক দিলেন। এসো সেলিম, আমার পাশে বসো। আমার কণ্ঠস্বর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সময় থাকতে আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।