ঠিক আছে তাই করো। তবে তাদের নিরবে আসতে বলো যাতে কোনো রকম ক্ষমতা প্রদর্শনের ঘটনা না ঘটে। বাবার মনে সন্দেহ বা দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হতে পারে এমন কিছু আমি করতে চাই না।
*
ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে ক্লান্ত পদক্ষেপে পরিচারকদের সহায়তায় হেঁটে এসে আকবর দরবার কক্ষের সিংহাসনে বসলেন। দুদিন আগে তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং হেকিমরা তার বমির সঙ্গে অপসৃয়মান রক্ত বন্ধ করতে পারেনি। অবশ্য রক্ত যাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমেছে, সেটা হয়তো এই জন্য যে তিনি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছেন। তার গায়ের চামড়া প্রায় স্বচ্ছ হয়ে পড়েছে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে যে এই দুর্বল বৃদ্ধ লোকটি এক সময় উৎফুল্ল চিত্তে আগ্রার দুর্গপ্রচীরের চারদিকে দৌড়াতে পারতেন দুই বগলে দুইজন পূর্ণবয়স্ক যুবককে নিয়ে। আকবরের পরিচারকরা যখন তার পিঠের পিছনে একটি বালিশ স্থাপন করছিলো সেলিম লক্ষ্য করলো তার বাবার মুখ ব্যথায় কুঁচকে উঠেছে। কিন্তু এক মুহূর্ত পর যন্ত্রণা সয়ে নিয়ে সম্রাট তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। আমার বিশ্বস্ত উপদেষ্টাগণ, আজ আমি তোমাদের ডেকেছি সম্ভবত আমার শাসন আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাকে সাহয্য করার জন্য। আকবর নিচু স্বরে কথা বললেন, কিন্তু অন্য সকল সময়ের মতোই তাঁকে কর্তৃত্বপূর্ণ শোনালো। আমার অসুস্থতা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। হয়তো শীঘই আমার মৃত্যু হবে। সেটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমার সাম্রাজ্য-মোগল সাম্রাজ্যকে উপযুক্ত হাতে সমর্পণ করা। সেলিম লক্ষ্য করলো খোসরু তার প্রিয় রুপালী ও বেগুনি পোষাকে সজ্জিত হয়ে আছে, সে উত্তেজনায় এক পা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে দাঁড়ালো।
আমার উচিত ছিলো বহু আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র সেলিম অথবা জ্যেষ্ঠ নাতি খোসর মধ্যে কাকে নির্বাচন করবো। ভেবেছিলাম আমি আরো অনেক বছর বাঁচবো, সেই জন্য আমি অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং পর্যবেক্ষণ করতে থাকি তাঁদের দুজনের মধ্যে কে সবচেয়ে যোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় প্রতিটি ক্ষণ আমার জন্য মহা অমূল্য সম্পদ এবং সিদ্ধান্ত আমি একাই নেবো। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদের মতামত শ্রবণ করতে চাই কারণ তোমরা আমার উপদেষ্টা। শুরু করো।
এক মুহূর্তের জন্য সেলিমের শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেলো। আগামী কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যাবে। শেখ সেলিম চিশতির কথা গুলি তার মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হলো- তুমি সম্রাট হবে- কিন্তু বালক অবস্থায় ফতেহপুর শিক্রির সেই উষ্ণ সন্ধ্যায় সুফির কাছে সাহায্যের জন্য দৌড়ে যাওয়ার পর অনেক কিছু ঘটে গেছে। চেষ্টা সত্ত্বেও কখনোই সে তার পিতার সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি কিম্বা মনোযোগ অর্জন করতে পারেনি। ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রলোভনে মরিয়া হয়ে নানা অঘটনে জড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারেও সে নিশ্চিত যে আবুল ফজলের হত্যাকাণ্ডের জন্য আকবর তাকে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারেননি যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। খোসরুর মামা অম্বরের রাজা মান সিং আকবরের দিকে কয়েক পদক্ষেপ অগ্রসর হলো। জাহাপনা, আপনি আমদের বিবেচনা জানতে চেয়েছেন তাই আমি আমার মতামত দিচ্ছি। আমি যুবরাজ খোসরুর প্রতি আমার সমর্থন প্রদান করছি। সে তরুণ, তার সম্মুখে অনেক গুলি বছর রয়েছে। আমি আমার ভগ্নিপতি যুবরাজ সেলিমকেও সম্মান করি, কিন্তু ইতোমধ্যেই সে তার মধ্যবয়সের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করেছে। তার উচিত তার পুত্রকে উপদেশ এবং নির্দেশনা প্রদান করা, সিংহাসনে আরোহণ করা তার ঠিক হবে না। কথা শেষ করে মান সিং এমন ভাবে তার মাথাটি ঝাঁকালো যাতে মনে হলো তার কাঁধের উপর থেকে কোনো ভারী বোঝা নেমে গেছে এবং তার জন্য কাজটি সহজ ছিলো না। কতো মারাত্মক কপটতা, সেলিম ভাবলো। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে মান সিং নিজ স্বার্থ উদ্ধারের আশায় ভাগ্নের জন্য সুপারিশ করছে।
আমি ওনার সঙ্গে একমত, আজিজ কোকা বলে উঠলো, সে আকবরের একজন তরুণ সেনাপতি। সেলিমের ঠোঁটে ভাজ পড়লো। জানা কথা খোসরু তাকে তার প্রধান সেনাপতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যদি সে সম্রাট হতে পারে। আমাদেরকে আরো গৌরব উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর করার জন্য যুবরাজ খোসরুর মতো একজন শক্তিশালী তরুণ নেতা প্রয়োজন, বলে আজিজ কোকা তার বক্তব্য শেষ করলো।
সমগ্র সভাকক্ষ জুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে এবং সেলিম লক্ষ্য করলো উপস্থিত সভাসদগণ পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছে। এরপর হাসান আমল, তরুণ বয়সে যার বাবা কাবুল থেকে হিন্দুস্তানে আসার সময় বাবরের সঙ্গী হয়েছিলেন, তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলেন।
না! যদিও তার বয়স আকবরের তুলনায় দশ বছরের মতো বেশি হবে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর সেই তুলনায় অনেক দৃঢ় শোনালো। আমাদের ইতিহাসে বহু বার দেখা গেছে সিংহাসন অধিকারের জন্য এক ভাই অন্য ভাই এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু মোগল গোত্র গুলির মধ্যে অতীতে এমনটা কখনোও দেখা যায়নি যে বাবাকে হটিয়ে পুত্রকে ক্ষমতা প্রদান করা হচ্ছে। আমাদের মহান সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী হতে পরে যুবরাজ সেলিম। এটা কেবল আমার মনের কথাই নয় বরং আমার বিশ্বাস এখানে উপস্থিত অনেকেই দুই যুবরাজকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া বিরোধের বিষয়ে দুর্ভাবনাগ্রস্ত। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত অশোভন এবং ভয়ঙ্কর। যদিও আমার বয়স তখন অত্যন্ত কম ছিলো কিন্তু সেই দিন গুলির কথা আমি ভুলিনি যখন হিন্দুস্তানে আমাদের অবস্থান পাকাঁপোক্ত হয়নি এবং এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ছিলো। কিন্তু বর্তমানে আমরা একটি অবিসংবাদী সম্রাজ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিপতি। মোগলদের চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আমাদের এই শক্তিশালী অবস্থানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না। ন্যায় বিচার এবং বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে এটাই যুক্তিযুক্ত যে সম্রাট আকবরের একমাত্র জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ সেলিম সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী। আমাদের অনেকের মতো সেও অনেক ভুল ত্রুটি সম্পাদন করেছে কিন্তু এই সঙ্গে অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি নিশ্চিত সে একজন দক্ষ সম্রাট হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে।