লড়াই বন্ধ করতে বলো! আকবর আদেশ দিলেন।
কয়েক মুহূর্ত পর লড়াই এর ব্যবস্থাপনার নিয়োজিত লোকেরা ঘেরের মধ্যে জ্বলন্ত পটকা নিক্ষেপ করতে লাগলো হাতি দুটির মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এবং তাদের পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। পটকার ঠাস ঠাস প্রচণ্ড শব্দ এবং ধোঁয়া দামোদরের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলো না, সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তার ঘাড়ের উপর তখনো আকড়ে থাকা আরোহীদের নিয়েই প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা মেরে ঘেরের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ সরতে না পারা তিন জন দর্শক তার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলো। আর আতঙ্কিত দামোদর নদীর পার দিয়ে ছুটতে লাগলো এবং ভীত দর্শকরা তার গতিপথ থেকে এদিক ওদিক ছুটে পালাতে লাগলো। তারপর সে নদীতে নেমে গিয়ে প্রায় মাঝ নদী বরাবর অগ্রসর হয়ে থমকে দাঁড়ালো এবং তার রক্তে নদীর পানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে লাগলো।
ওদিকে ঘেরের ভিতর বাসু পৃথ্বী কম্পকের ঘাড়ের উপর দিয়ে ছেড়ে অগ্রসর হয়ে সূরজের বসার স্থানটি দখল করলো এবং পটকার শব্দ এবং দর্শকদের চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেও হাতিটিকে শান্ত করতে সক্ষম হলো এবং সেটার চোখ দুটি একটি পট্টি দিয়ে ঢেকে দিলো। ঘেরের মধ্যবর্তী স্থানে তখন সূরজের পদদলিত দেহটি একটি রক্তাক্ত মাংস পিণ্ডের মতো পড়ে রয়েছে। সেলিম তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে ফিরে চিৎকার করে বলে উঠলো, তোমার মাহুত বুঝতে পেরেছিলো যে আমার হাতিটি জয়ী হতে যাচ্ছে তাই সে অসৎপন্থা অবলম্বন করে আমার মাহুতকে ফেলে দিয়ে একটি সাহসী লোকের অনর্থক মৃত্যু ঘটালো।
যা ঘটলো তা একটি দুর্ঘটনা। সেলিমের চোখের দিকে না তাকিয়ে খোসরু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো, তার মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠেছে।
তুমি ভালো করেই জানো তুমি মিথ্যা কথা বলছে। যেহেতু তোমার হাতি লড়াই এর ঘের ছেড়ে দৌড়ে পালিয়েছে তাই আমার মৃত মাহুতের নামে আমি বিজয় দাবি করছি।
কারো হাতি জয়ী হয়নি, লড়াই অমিমাংসিত ভাবে শেষ হয়েছে। দাদা, আপনার কি মতো… খোসরু আকবরের কাছে সমাধান চাইলো কিন্তু সম্রাটকে অন্যমনষ্ক মনে হলো। তিনি তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং বারান্দার রেলিং ধরে একাগ্রচিত্তে নিচের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, দুজন পরিচারক তাঁকে দুদিক থেকে ধরে রেখেছে। আকবর এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন বোঝার জন্য সেলিমও এগিয়ে গেলো। দর্শকরা ঠেলাঠেলি করে সূরজের দেহাবশেষ দেখার চেষ্টা করছে পরিচারকরা যা একত্রে জড়ো করে খাঁটিয়ায় তুলে মাঠ থেকে বের করে নিচ্ছে। কিন্তু তখনই ক্রুদ্ধ হৈ-চৈ শোনা গেলো এবং সেলিম দেখলো তার এবং খোসরুর সমর্থকদের মধ্যে মারপিট শুরু হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে দেখতে পেলো খোসরুর একজন পরিচারক কোমরে গোজা ছোরা টেনে বের করে তার একজন ভূতের মুখে পোচ মারলো। দেখতে দেখতে আরো বেশি লোক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো।
সেলিম! খোসরু! তোমাদের লোকেরা আমার সামনে এমন বিশ্রী ভাবে ঝগড়া মারামারি করার সাহস পেলো কীভাবে! তাঁদের উপর তোমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? তোমাদের দুজনেরই লজ্জা হওয়া উচিত। আকবর ক্রোধে থর থর করে কাঁপছেন। খুররম, মনে হচ্ছে একমাত্র তোমার উপরই আমি আস্থা রাখতে পারি। এক্ষুনি আমার রক্ষীদের অধিনায়কের কাছে যাও এবং তাকে আদেশ দাও এই গোলযোগ বন্ধ করতে। আর একজন লোক যদি অস্ত্র তোলে তাকে গ্রেপ্তার করে চাবুক পেটা করতে বলো।
জ্বী দাদা, আমি যাচ্ছি, কথা গুলি বলে খুররম দৌড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
আর তোমরা, সেলিম এবং খোসরু, আমার সামনে থেকে দূর হও। তোমাদের দুজনের ব্যাপারেই আমি হতাশ হয়েছি।
খোসরু তখনই প্রস্থান করলো কিন্তু সেলিম ইতস্তত করতে লাগলো। তার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে ইচ্ছা হলো, কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে? সে যাই বলুক না কেনো বাবার মনোভাব তাতে পরিবর্তিত হবে না। সে পিছন ফিরে এক পলক আকবরের দিকে তাকালো। কিন্তু আকবরের থমথমে চেহারায় তাকে সেখানে থাকতে বলার কোনো আভাস পাওয়া গেলো না- সেলিম ধীর পদক্ষেপে বারান্দা ত্যাগ করলো। শুধু সেই নয়, খোসরুও আকবরের অসন্তুষ্টির কিছুটা ভাগ পেয়েছে, একথা ভেবে সেলিম কিছুটা সান্ত্বনা পেলো। কিন্তু তারপর আরেকটি ভাবনা তার মনে আঘাত করলো। খুররমকে লক্ষ্য করে বাবা যে মন্তব্য করলেন সেটার তাৎপর্য কি? মনে হচ্ছে একমাত্র তোমার উপরই আমি আস্থা রাখতে পারি…। তারা দুজন যখন আবার একত্রে সময় কাটাবে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তখন খুররমকে বাবা আজকের ঘটনাবলী সম্পর্কে কি বলবেন? এই যে, সেলিম এবং খোসরুর মধ্যকার নগ্ন বিরোধীতা দেখে তিনি মনে করছেন তাঁদের কেউই সাম্রাজ্য শাসন করার উপযুক্ত নয়?
৬.২ পৃথিবীর অধীশ্বর
২৯. পৃথিবীর অধীশ্বর
আমার কোৰ্চি আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জানালো বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর কি সমস্যা হয়েছে? মোলশ পাঁচ সালের অক্টোবর মাসের এক ভোর বেলায় সেলিম আকবরের প্রধান হেকিমকে জিজ্ঞেস করলো।
মহামান্য সম্রাট তিন ঘন্টা আগে প্রচণ্ড পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং বমি করা শুরু করেছেন, বয়স্ক এবং মর্যাদা সম্পন্ন চেহারার অধিকারী আহমেদ মালিক উত্তর দিলো। ঘাড়ের উপর দিয়ে পিছনে তাকিয়ে আকবরের শয়নকক্ষের বাইরে প্রহরারত রক্ষীদের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে সে গলার স্বর নিচু করে আবার কথা বলে উঠলো, প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তাঁকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে।