ঘাড় ফিরিয়ে সেলিম তার নিজের হাতিটির দিকে তাকালো- যোধ বাই এর বাবা হাতিটি তাকে উপহার দিয়েছেন। পৃথ্বী কম্পক ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। তার ঘাড়ের উপর সূরজ এর পিছনে বাসু বসে আছে। এই হাতিটির উচ্চতা খোসরুরটির তুলনায় প্রায় এক ফুট কম কিন্তু সেটার রুপালী রঙ করা দাঁত গুলি দামোদরের তুলনায় বড় এবং বেশি বাঁকানো। রাজপুতগণ তাদের হাতিগুলিকে উত্তম প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং পৃথ্বী কম্পক বহুবার নিজের নির্ভীকতা প্রমাণ করেছে।
যেই মুহূর্তে দামোদর এবং পৃথ্বী কম্পক ঘেরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব স্থানে প্রবেশ করলো তখনই প্রবেশের ফাঁক গুলি মাটির বস্তা ফেলে বন্ধ করে দেয়া হলো। ওদিকে উভয় হাতির আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলা হলো এবং সেগুলি পরস্পরকে লক্ষ্য করে ক্রুদ্ধ ভাবে শুর বাজাতে লাগলো এবং মাথা দোলাতে লাগলো। সেলিমের হৃদস্পন্দর দ্রুততর হলো। সে খোসরুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সেও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে কারণ তার বুক ঘন ঘন উঠা নামা করছে। নিজ পুত্র সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ কি ভুল? সত্যিই কি তার পিতার বিনোদনের জন্য এই লড়াই এর আয়োজন করা হয়েছে? কিন্তু যখন দেখলো আবার খোসর সামনে ঝুঁকে আকবরের কানে কানে ফিসফিস করছে, তখন সেলিম নিশ্চিত হলো যে তার পুত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ সঠিক।
কয়েক জন তরুণ হাতি গুলির পায়ের নিচে ঢুকে শিকল গুলি খুলে নিচ্ছিলো। শিকল উন্মুক্তকারীরা লড়াই এর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই খোসরুর হাতিটিকে মাঠের মধ্যবর্তী বাধের দিকে ছুটতে দেখে দর্শকরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। দামোদর বাধের কাছে পৌঁছে উচ্চস্বরে শুর বাজিয়ে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে সামনের পা দুটি উপরে তুললো তারপর বাধটি ভেঙে ফেলার জন্য সেটার উপর সজোরে পা দুটি নমিয়ে আনলো। তারপর কিছুটা পিছিয়ে এসে পুনরায় অগ্রসর হওয়ার উদ্যোগ নিলো। ওদিকে বাধের অন্য পাশে অবস্থিত পৃথ্বী কম্পক সূরজ এর কোমল টোকার ইঙ্গিতে ধীরে বাধের কাছ থেকে পিছাতে লাগলো। সেলিম দেখলো খোসরু দাঁত বের করে হাসছে যখন দামোদর পুনরায় বাধটি ভাঙার চেষ্টায় এগিয়ে গেলো।
কয়েক মুহূর্ত পর ঘাড়ের উপর শক্তভাবে এঁটে থাকা আরোহীদের নিয়ে ক্রোধে ফুঁসতে থাকা দামোদর তার বিশাল থামের মতো পায়ের আঘাতে বাধের অবশিষ্টাংশ ভেঙে ফেললো। তারপর মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথ্বী কম্পককে আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো, তার পদাঘাতে চারদিকে মাটি বালু ছিটকে পড়তে লাগলো। সূরজ পৃথ্বী কম্পককে তখনো স্থির রেখেছে, সেলিম এবং সে মিলে এমন পরিকল্পনাই করেছিলো যে প্রতিপক্ষকে প্রথমে তারা দ্রুত আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করবে। হাতির লড়াই এর বিষয়ে আগে থেকে কিছুই অনুমান করা যায় না তবে এটা একটি উত্তম কৌশল, সেলিম মনে মনে নিজেকে বললো। খোসরুর হাতির তুলনায় পৃথ্বী কম্পক ছোট তবে তার চলার গতি সেটার তুলনায় বেশি ক্ষিপ্র।
যখন দামোদর গুঁড় উঁচিয়ে দাঁতগুলিকে সমান্তরাল রেখে ভয়ংকর মৃত্যু দূতের মতো এগিয়ে এলো সেলিমের মনে হলো হয়তো সূরজ বেশি দেরি করে ফেলছে। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে যখন মনে হলো দামোদর তাদের উপর আঘাত হানবে সূরজ চিৎকার করে নির্দেশ প্রদান করলো এবং পৃথ্বী কম্পকের ডান কাঁধে ধাতব দণ্ড দিয়ে টোকা দিলো। নির্দেশনা পেয়ে পৃথ্বী কম্পক দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে দামোদরের আক্রমণ এড়ালো। একই সঙ্গে মাথা হেলিয়ে তার ঘষে ধারালো করা দাঁত দিয়ে অগ্রসরমান দামোদরের দেহের বাম পাশে গুঁতো দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দামোদরের দেহে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। যেই দামোদর থমকে গেলো এবং শুর বাজিয়ে আর্তনাদ করতে লাগলো সূরজ তাকে ধাওয়া করলো। ঘেরে প্রবেশের পথ আটকানো মাটির বস্তার কাছে তারা দামোদরের নাগাল পেলো। দামোদরের মাহুত তখন চেষ্টা করছে তার আহত এবং ভীত হাতিটিকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য এবং সে কোনো রকমে তাকে ঘুরিয়ে পৃথ্বী কম্পকের মুখোমুখী করতে পারলো।
তাঁদের মাহুতদের তাগিদে এবং উল্লাসিত জনতার চিৎকারের প্রভাবে হাতি দুটি কয়েক বার পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো এবং আবার সজোরে মাটির উপর পা নামিয়ে আনলো। উভয়েই চেষ্টা করলো পরস্পরকে দাঁত বিদ্ধ করতে। কয়েক মুহূর্ত পর পৃথ্বী কম্পক সফল হলো দামোদরের ইস্পাতের আবরণের নিচের অংশের শুড় দাঁতের আঘাতে চিড়ে ফেলতে। তারপর, দামোদর যেই টলমল পায়ে পিছু হটলো, পৃথ্বী কম্পক এগিয়ে গিয়ে একটি দাঁত সেটার ডান কাঁধের গভীরে ঢুকিয়ে দিলো। খোসরুকে আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিলো না। পৃথ্বী কম্পকের জয় আর বেশি দূরে নয়, সেলিম ভাবলো। কিন্তু উন্মত্ত হাতি দুটি আবার যখন পরস্পরের কাছাকাছি হলো, দামোদরের মাহুত তার ধাতব দণ্ডটি হাতে সামনের দিকে ঝুঁকলো। তাকে দেখে মনে হলো সে নিজের হাতিটিকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ দামোদরের ঘাড়ে পেচিয়ে বাধা একটি চামড়ার ফালি আকড়ে ধরে সামনের দিকে হেলে পড়লো এবং তড়িৎ গতিতে হাতের দণ্ডটির বাঁকা অংশটি সূরজের এক পায়ে আটকে সজোরে টান দিলো। ভারসাম্য হারিয়ে সূরজ এক মুহূর্ত টলমল করলো, তারপর পৃথী কম্পকের ঘাড়ের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেলো। সেলিম যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান থেকে বুঝতে পারলো না সূরজের পরিণতি কি হলো কিন্তু উপস্থিত জনতা সমস্বরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালো।