হয়তো তাই। তবে এ ব্যাপারে আমি খুশি যে আবুল ফজলের সুপারিশে পদন্নোতি পাওয়া কিছু বয়স্ক সভাসদ খোসরুর দলের উদ্ধত আচরণে বিরক্ত হয়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন প্রদান করছে। হয়তো, আমি যতোটা মনে করি বাবা তার তুলনায় অনেক বেশি বিচক্ষণ এবং সবদিক বিবেচনা করেই তিনি তার উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আমি তোমার সঙ্গে একমত। যদিও ম্রাট শারীরিক ভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন কিন্তু তার বিচারবুদ্ধিকে ছোট করে দেখা উচিত নয়।
*
কি ব্যাপার খুররম? নিজের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রকে উঠান পার হয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সেলিম বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, সে এবং সুলায়মান বেগ তখন দাবা খেলছিলো।
দাদা তোমার এবং খোসরুর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধহাতি দুটির লড়াই দেখতে চান। তিনি মনে করেন এ ধরনের লড়াই তার সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভে সহায়ক হবে।
সেলিম এবং সুলায়মান বেগ পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কখনো? আজ বিকেলে, পরিবেশ যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। দাদা আরো বলেছেন দুর্গের সামনে যমুনার তীরে লড়াইটির আয়োজন করতে যাতে তিনি ঝরোকা বারান্দায় বসে তা দেখতে পান।
তোমার দাদাকে গিয়ে বলল আমি তার প্রস্তাবে অত্যন্ত খুশি হয়েছি এবং আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় হাতি পৃথ্বী কম্পককে লড়াই এ নামাবো।
ঠিক আছে বাবা।
তোমার ভাই এর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?
আজকে দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসে খোসই এই লড়াই এর আবেদন উত্থাপন করে। অল্পদিন আগে বাংলা থেকে আমদানী করা দামোদর নামের তার একটি দৈত্যাকার হাতি সম্পর্কে সে খুব প্রশংসা করছিলো। সে বলেছে দামোদর কখনোও লড়াই এ পরাজিত হয়নি।
লড়াইটা তাহলে ভালোই জমবে। কারণ পৃথ্বী কম্পকও আগে কখনোও পরাজিত হয়নি। সেলিম তার পুত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলো, কিন্তু যেই খুররম প্রস্থান করলো ওমনি তার হাসি অপসারিত হলো। খোসরু উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই লড়াই এর ফন্দি এটেছে, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। সে সমগ্র রাজসভার সম্মুখে আমাকে পরাজিত করতে চায়।
হয়তো তাই। কিন্তু সে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছে যে তার হাতি তোমার হাতিকে পরাজিত করতে পারবে?
তার অহংকারই তার মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে। অবশ্য যদি তার জয় নাও হয় সে সকলের সামনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো যে তার এবং আমার মর্যাদা সমান এবং আমরা উভয়েই সম্রাটের আনুকূল্য প্রার্থী। অন্য যে কারো চেয়ে তুমি বিষয়টা বেশি বুঝো কারণ তুমি সেই ক্ষতটি বহন করছে। বিজয়কে সে মনে করবে তার প্রতি পূর্বাভাষ বা দৈবইঙ্গিত স্বরূপ।
তাহলে এখন তুমি কি করবে?
যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যাতে আমার হাতিটি জয়ী হয়। আমার সবচেয়ে দক্ষ মাহুত সূরজ এবং বাসুকে খবর দাও। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমাদের হাতে এখনোও কয়েক ঘন্টা সময় আছে।
*
হাতি লড়াই এর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো এবং সময় যতোই কাছিয়ে আসতে লাগলো উৎসুক জনতা আগ্রাদুর্গের সম্মুখবর্তী উত্তপ্ত নদীপারে ভিড় জমাতে লাগলো। লড়াই এর জন্য দুইশ ফুট লম্বা এবং পঞ্চাশ ফুট চওড়া জয়গার চারদিক মাটি ভর্তি বস্তা ফেলে একজন মানুষের কাঁধ সমান উঁচু করা হয়েছে। ঘেরের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে হাতিদের প্রবেশের জন্য ফাঁক রাখা হয়েছে। ঘেরের মধ্যখানে আড়াআড়ি ভাবে ছয়ফুট উঁচু আরেকটি মাটির বাধ দিয়ে ঘেরটিকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।
ঝরোকা বারান্দায় নিচু সিংহাসনে বসে থাকা আকবরের পিছনে সেলিম, খোসরু এবং খুররম দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকবরের গায়ে কারুকাজ করা সূক্ষ্ম কাশ্মীরি পশমের শাল জড়ানো রয়েছে। নিচে উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে সেলিম লক্ষ্য করলো বেগুনি জোব্বা এবং রুপার সুতায় বোনা বস্ত্রের পাগড়ি পড়ে খোসরুর সমর্থকরা সেখানে হাজির হয়েছে। লাল এবং সোনালী পোষাক পরিহিত তার নিজের সমর্থকদেরও সেখানে দেখতে পেলো যাদের মধ্যে জাহেদ বাট রয়েছে যে তার দেহরক্ষীদের অধিনায়ক। সেলিম নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে এক পলক তাকালো। খোসরুকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে এবং সে আকবরকে কিছু বলতেই তিনি হেসে উঠলেন।
সম্রাট তার হাত উঁচু করলেন এবং তার সংকেত পেয়ে দুর্গপ্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা শিঙ্গা বাদক তার ছয়ফুট লম্বা ব্রোঞ্জের শিঙ্গাটি ঠোঁটে লাগিয়ে তিনটি সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ তুললো। এটা হাতিমহল থেকে হাতি গুলিকে লড়াই এর স্থানের দিকে নিয়ে আসার সংকেত। নাকাড়ার (এক জাতীয় ঢোল) তালে তালে প্রথমে পনেরো ফুট উঁচু দামোদর লড়াই এর ঘেরের দিকে এগিয়ে গেলো। তার গায়ে বেগুনি মখমলের আচ্ছাদন যাতে রুপালী পাড় লাগানো রয়েছে। তার বিশাল পা গুলিতে ঢিলা করে রুপার শিকল লাগানো রয়েছে যাতে হঠাৎ করে দৌড়দিতে না পারে। সেটার মাহুত ঘাড়ের উপর বসে আছে, তার হাতে হাতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করার বাকানো ধাতব দণ্ড। দ্বিতীয় একজন মাহুত প্রথম জনের পিছনে বসে আছে। প্রথম জন যদি আহত হয় বা পড়ে যায় তাহলে সে হাতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য দামোদরের কপাল এবং চোখের উপর উজ্জ্বল ইস্পাতের পাত পড়ানো হয়েছে। যেটা তার গুঁড়ের অর্ধেক পর্যন্ত বিস্তৃত। সেটার দাঁত গুলি সোনালী রঙ করা হয়েছে অগ্রভাগের কিছু অংশ ছাড়া। দুর্গ থেকে বেরিয়ে দামোদর যখন রাজকীয় ভঙ্গীতে লড়াই এর ঘেরের দিকে এগিয়ে গেলো খোসরুর সমর্থকরা সমস্বরে চিৎকার করে তাঁদের সমর্থন জানালো।