খোসরু এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো, তারপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, আমিও চাই সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলুক। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে আমরা সকলে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল।
তাদের তীর ধনুকের অনুশীলন অব্যাহত থাকলো, পিতা পুত্র নিজেদের বক্তব্যকে সংঘর্ষের দিকে গড়াতে না দিয়ে রাজপ্রাসাদের দৈনন্দিন বিষয়াদির দিকে তাদের আলাপকে কেন্দ্রীভূত করলো। যাইহোক, অনুশীলন শেষে সেলিম যখন তার তীরধনুক গোলাপকাঠের বাক্সে ভরতে লাগলো এবং খোসরু উঠান পার হয়ে তার দাদার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য হাতিশালের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো, তখন সেলিম অনুভব করলো তার তেজস্বী জ্যেষ্ঠ পুত্রের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুন ইতোমধ্যেই প্রজ্জলিত হয়ে গেছে, তাতে তার পিতার কোনো ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক। এখন তাকে একাধারে তার সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং শত্রুদের প্রশমিত করতে হবে। সব কিছুর উপরে তার বাবাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এর জন্য নিজের সত্যিকার ইচ্ছা গুলিকে দমন করতে হলেও কিছু যায় আসে না। সেটা তার জন্য কিছুটা কষ্টকর হবে কিন্তু বিনিময়ে যে সিংহাসন সে। লাভ করবে তার তুলনায় এই কষ্ট খুবই তুচ্ছ।
*
সেলিম এবং আকবর উভয়ের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের সম্মুখে মৃতদেহের খাঁটিয়াটি আগ্রাদুর্গের পাশ্ববর্তী একটি দ্বার দিয়ে বয়ে নিয়ে একটি ফুলে ঢাকা সাধারণ শবযানের উপর স্থাপন করা হলো। তারপর শবানটিকে ঠেলে নৌকায় উঠান হলো। যমুনা নদী পথে মৃতদেহটি দিল্লীতে নিয়ে হুমায়ূনের পাশে দাফন করা হবে। হামিদার মৃত্যু শোক যেভাবে পিতাপুত্রকে একত্রিত করেছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারলে স্বয়ং হামিদা অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। তিনি খুব কোমল ভাবে তার আটাত্তর বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে শায়িত হয়েছেন মাত্র কয়েক দিন অসুস্থ থাকার পর। প্রথমে যা সামান্য কাশি দিয়ে শুরু হয়েছিলো তাই শেষ পর্যন্ত মারাত্মক কিছুতে পরিবর্তিত হয়।
সেলিম এবং আকবর হামিদার নিচু বিছানার দুপাশে বসেছিলো যখন তিনি তাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। বুকে জমে উঠা কফের কারণে তিনি ফিসফিস করে বলছিলেন তারা যেনো পরস্পরকে ভালোবাসে যেমনটা তিনি তাদেরকে বেসেছেন। তার জন্য না হলেও সাম্রাজ্যের স্বার্থে যেনো তারা তার শেষ ইচ্ছাটি রক্ষা করে সেই অনুরোধও তিনি করেন। হামিদার অনুরোধে আকবর এবং সেলিম তার দুর্বল দেহেরে উপর দিয়ে নিজেদের হাত প্রসারিত করে পরস্পকে ধরে তাঁর আদেশ পালনের ব্যাপারে সম্মত হয়। এর কয়েক মিনিট পরেই জানালা দিয়ে পৌঁছানো কোমল জ্যোছনার আলোতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর শেষ কথা গুলি ছিলো, তারাদের মধ্য দিয়ে স্বর্গে তোমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমি আসছি হুমায়ুন।
নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যুদ্ধ করতে করতে সেলিম অনুমান করার চেষ্টা করলো তার বাবার মনের অবস্থা এখন কেমন। কয়েক মাস আগে দাদী গুলবদনের মৃত্যু হয়েছে আর এখন হামিদাও চলে গেলেন। বাবা কি এখন তাঁর নিজের মরণশীলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছেন? তিনিই এখন তাঁর পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য- অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই তিনি পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করে আসছেন। তিনি আজ তাঁর সেই মাকে হারালেন যিনি তাঁকে শৈশবের নানা প্রতিকূলতা এবং মৃত্যু ঝুঁকি থেকে রক্ষা করেছিলেন। আকবরের প্রতি হামিদার ভালোবাসা ছিলো নিঃস্বার্থ যেমনটা সেলিমের প্রতিও। সেই জন্য সেলিম তাঁর অভাব তীব্র ভাবে অনুভব করবে।
কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং অসময়ে বুড়িয়ে যাওয়া দানিয়েলের দিকে তাকালো সেলিম। সে তার পিতার আরেক পাশে রয়েছে। এখনোও টিকে থাকা তার একমাত্র সম্ভাইটি এক ঘন্টা আগে রাজধানীতে এসে পৌঁছেছে। আকবরের নির্দেশে ফতেহপুর শিক্রির কাছে অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন রাজপ্রাসাদ বর্তমানে তার আবাস। তার সমস্ত দেহ থর থর করে কাঁপছে। সেলিম অনুমান করলো এই কম্পন হয় অতিরিক্ত মদ্য পানের জন্য অথবা মদের অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে। তবে অবশ্যই তা শোকের জন্য নয়। তারপর সেলিম তার নিজের তিন পুত্র খোসরু, পারভেজ এবং খুররম এর দিকে তাকালো যারা দানিয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সম্ভবত তার নিজের বা আকবরের মতো শোকাহত হয়নি। কারণ তারা তার মতো দীর্ঘসময় ধরে হামিদার আদরস্নেহ পায়নি এবং তার মতো তাঁকে চিনতেও পারেনি।
হামিদা তাকে বুঝতেন। তার মদ্যপান, ওপিয়াম সেবন, তার কামনাবাসনা কিছুই তার অজানা ছিলো না। শুধু তাই নয় তার অল্পতেই রেগে উঠা, তার ধৈর্যহীনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রতিশোধ পরায়ণতা বিশেষ করে আবুল ফজলের ব্যাপারে প্রভৃতি কিছুই তার অজানা ছিলো না। যাইহোক, এই সব দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি তার উপর আস্থা হারাননি। সেলিম আকবরের অশ্রুভেজা মুখের দিকে তাকালো এবং নিজের অজান্তেই তাঁর কোনোই স্পষ্ট করলো তাঁর শোকের সমব্যথি হিসেবে। অত্যন্ত ধীর এবং শোকাবহ লয়ে ঢাক পেটানো শুরু হলো যখন হামিদাকে বহনকারী খাঁটিয়াটি নৌকায় তোলা হলো। প্রিয় মাকে শেষ বিদায় জানানোর বেদনাবিধূরক্ষণে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে তার বাহু আকড়ে ধরে থাকার সুযোগ দিলেন।