ঐ টুলটির উপর বসো সেলিম যাতে আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখতে পাই, হামিদা বললেন। সেলিম বসল যদিও তার অস্থির মন চাচ্ছিলো ঘরময় পায়চারি করতে। কোনো রকম ভূমিকা না করে হামিদা কথা বলা শুরু করলেন, তার কণ্ঠস্বর আগের মতোই নরম এবং কর্তৃত্বপূর্ণ।
সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তোমার সেনাশক্তি প্রদর্শন এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন। তোমাকে তোমর বাবার সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া বিরোধ মিটিয়ে ফেলে আমাদের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।
আমাদের পরিবারের জন্য হুমকি সৃষ্টি করা কখনোই আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। আমি আমাদের বংশানুক্রমকে শ্রদ্ধা করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষের কীর্তি সমূহের প্রতিও আমার ব্যাপক সমবোধ রয়েছে। আমিও চাই আমাদের ম্রাজ্যের আরো সমৃদ্ধি হোক। কিন্তু বাবা এতোদিন যাবত রাষ্ট্রীয় কাজে আমার অবদান রাখার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেছেন। আমার সকল কর্মকাণ্ডকে তিনি তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করেন।
তার এমন মনোভাবের স্বপক্ষে কি যথেষ্ট যুক্তি নেই যখন তুমি তার প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রিয় বন্ধুকে হত্যা করিয়েছো?
আমি…
অস্বীকার করো না, সেলিম। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে কখনোই কপটতা স্থান পায়নি।
আবুল ফজল তার প্রভাব এবং ক্ষমতার প্রতি আমাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। তার কপটতা এবং দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে আমাকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে আসছে। তার মৃত্যুর ফলে রাজসভা এখন থেকে আবার নতুন নিয়মে চালিত হবে।
তোমার সঙ্গে তোমার পিতার সম্পর্কও হয়তো নতুন দিকে মোড় নেবে। কিন্তু তোমার মাঝে কি সেই বিবেচনা শক্তি রয়েছে যার দ্বারা তুমি তোমার পিতার অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে উপলব্ধি করতে পারবে যে আবুল ফজলের মৃত্যু তাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে? বেশি ভাবার দরকার নেই। আমিই তোমাকে পরিস্থিতিটি বুঝিয়ে দিচ্ছি। চিন্তা করো তখন তোমার কেমন লাগবে যদি তোমার বাবা সুলায়মান বেগকে হত্যা করান। তার নিজের দুধভাই এবং দুধমা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পর থেকে সে আর কাউকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারেনি। সেই একই কারণে হয়তো সে তোমাকে বা তোমার সভাইদের সত্যিকার কোনো ক্ষমতা প্রদান করতে কুণ্ঠিত হয়েছে। যাইহোক, এক সময় সে আবুল ফজলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে আরম্ভ করেছিলো। ভেবে দেখো বিষয়টি কেমন দাঁড়ালো যখন সে জানতে পারলো যে ছেলেকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি তারই নির্দেশে তার বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আবুল ফজলের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে সে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে প্রায় পড়ে যেতে নিয়েছিলো। পরিচারকদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় সে তার শয়ন কক্ষে পৌঁছায়। সেখানে সে একনাগারে দুই দিন একা অবস্থান করে। এই দুদিন সে কারো সঙ্গে দেখা করেনি এবং কোনো খাবার গ্রহণ করেনি। তারপর যখন সে পুনরায় সভায় উপস্থিত হয় তার চোখ দুটি ছিলো রক্তাভ এবং মুখে দুদিনের না কামান খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে অবুল ফজলের মৃত্যুর জন্য এক সপ্তাহ শোক পালনের ঘোষণা দেয়। তারপর সে সরাসরি তোমার মায়ের কাছে গিয়ে তোমার মতো অকৃতজ্ঞ সন্তানকে জন্ম দেয়ার জন্য তাকে তিরস্কার করতে থাকে। তোমার মা তার স্বামীকে জবাব দেয় যে সে এই কারণে খুশি যে তুমি তোমার বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হয়েছে।
নিজের বাবা মায়ের মুখোমুখী অবস্থান নেয়ার ঘটনাটি কল্পনা করে সেলিম হাসলো।
তোমার বাবার শোক আনন্দে হাসার মতো কোনো ঘটনা নয়। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করলোম তখন সে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে আমাকে বলে, আমি জানি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সেলিমের হাত রয়েছে। আমি বাবা হিসেবে এমন কি অন্যায় করেছি যার কারণে সে আমাকে এমন প্রতিদান দিলো? আমার প্রজা এবং সভাসদগণ আমাকে সম্মান করে এবং ভালোবাসে। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র কেনো তা পারে না? আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে তুমি এখনোও তরুণ এবং এ কারণেই তুমি তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি অনেক বেশি উচ্ছ্বাস প্রবণ। এবং তোমার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে। আমি তাকে আরো স্মরণ করিয়ে দেই যে তার নিজের পিতা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে তার সঙ্গে তার ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়নি। তাছাড়া সম্রাট হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সে তার নিজের অভিভাবকের প্রতিও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছিলো। সে প্রথমে অনিচ্ছুক ভাবে আমার কথা স্বীকার করে নেয়। যাইহোক, পরবর্তী দিন গুলিতে আরো বিস্তারিত আলোচনার পর আমি তার কাছে আবেদন করি যাতে সে তার সর্বজনবিদিত মহানুভবতা এবং বিচক্ষণতা বলে তোমাকে ক্ষমা করে দেয়। তারপর সে আমার সঙ্গে এই মর্মে একমত পোষণ করে যে আমি তোমার কাছে এসে তোমাদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে তোমাকে রাজি করাবো।
তুমি মিমাংসার উদ্যোগ নিয়ে আমার কাছে আসায় আমি সত্যিই অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু বাবার স্বভাবে কি সত্যিই এমন পরিবর্তন এসেছে যার ফলে তিনি আমাকে সেই ক্ষমতা প্রদান করবেন যা আমি কামনা করি? তিনি কি সেই পুরুষ বাঘের মতো নয় যে তার নিজের সাবককে খেয়ে ফেলে যে তার কর্তৃত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে?