সেই দিন রাতে নিজ শয়নকক্ষে ফেরার সময়ও আকবর গভীরভাবে চিন্তামগ্ন ছিলেন। তিনি দেখলেন একজন বৃদ্ধা মহিলা তার শয়ন কক্ষের প্রবেশ দ্বারে তার একজন পরিচারকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট এই মহিলাটিকে আপনার হেরেমের তদারকে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং সে আপনাকে কিছু বলতে চায়, পরিচারকটি বললো।
বৃদ্ধাটির কুঁচকে যাওয়া মুখের দৃষ্টি এই বয়সেরও উজ্জ্বল এবং তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি আপনার পিতারও খেদমত করেছি সম্রাট এবং তাঁর রক্ষিতাদের দেখাশোনা করেছি যখন তিনি তরুণ যুবরাজ ছিলেন, বৃদ্ধাটি মুখ খুললো। তারপর সে একটু বিরতি নিলো, আকবর অনুভব করলেন বৃদ্ধাটি সাগ্রহে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে।
তুমি আমাকে কি বলতে চাও? রাতের আবহাওয়া আকবরের কাছে উষ্ণ ও ভারী বলে অনুভূত হচ্ছিলো এবং তিনি ক্লান্তি বোধ করছিলেন। কেনো যেনো তিনি পরিস্থিতি ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না এবং বৃদ্ধাটির অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি বোধ করছিলেন।
সম্রাট, বর্তমানে আপনার হেরেমে অনেক মেয়ে রয়েছে, আপনার আনুকূল্য লাভের আশায় বিভিন্ন গোত্রপতি এবং রাজারা তাদের পাঠিয়েছে। আপনার দৈহিক গড়ন বহু প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ঈর্ষার বিষয় এবং সকল তরুণী এর প্রশংসায় অজ্ঞান। তাই ভাবলাম আপনার মর্জি হলে কোনো তরুণীকে আপনার কাছে পাঠাই অথবা আপনি নিজেই কাউকে বেছে নিতে পারেন। আকরব সরাসরি বৃদ্ধার দিকে তাকালেন, লজ্জায় তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। ইদানিং তার দুধভাই আদম খান প্রায়ই তাকে নিয়ে কৌতুক করতো এই জন্য যে-যদিও আকবরের বয়স সেসময় পনেরোর কাছাকাছি, তখনো তার কৌমার্য বজায় আছে। বহু তরুণী-এমনকি তার মায়ের সেবিকারা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্ট করেছে। প্রতিবার তিনি ভীষণ লজ্জাবোধ করেছেন। তিনি বুঝতে পারেননি কি কারণে তার এমন অনুভূতি হয়েছে। সেটা কি এই জন্য যে, সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি নারী সংক্রান্ত বিষয়ে অনভিজ্ঞ? এবং সেটা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা? এমনকি একজন রক্ষিতার কাছেও? কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছিলো। তিনি সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ লড়েছেন এবং পূর্ণাঙ্গ পুরুষে পরিণত হচ্ছেন। তার তখন সময় হয়েছে একজন পুরুষের সুখানুভূতির স্বাদ নেয়ার। আদম খানের কৌতুক থেকে সৃষ্ট কৌতূহল এবং নিজস্ব যৌন অনুভূতি তাঁকে উদ্দীপিত করে তুললো। হেরেম তদারককারিনী বৃদ্ধাটির দৃষ্টি তার উপর তখনো নিবদ্ধ এবং তিনি অনুভব করলেন সম্ভবত সেও জানে তিনি ইতোপূর্বে নারীসঙ্গ লাভ করেননি।
আমি একটি মেয়েকে আপনার জন্য পছন্দ করে দেবো, সম্রাট? সে জিজ্ঞেস করলো।
আকবর ইতস্তত করলেন, তার রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলো, এক মুহূর্তের জন্য। ঠিক আছে, ভাবছেন অত্যন্ত মেপে ও অভিজ্ঞভাবে তিনি কথা বলতে পারছেন।
আপনি নিজেই কি হেরেমে আসবেন জাঁহাপনা?
আকবরের মনে হলো তিনি সেখানে যাওয়ার সময় সকলের দৃষ্টি এবং কান তার গতিবিধির উপর নিবদ্ধ হবে। লাহোরের এই রাজপ্রাসাদের হেরেমে রাজপরিবারের সকল মহিলা অবস্থান করছিলো, তাদের মধ্যে তাঁর মা, ফুফু এবং দুধমাও আছেন। নিজের উপর তাদের অনুমান ও কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টি যতোই স্নেহসিক্ত হোক না কেনো-সেটা কল্পনা করে আকবর আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। এটাই তার জন্য উপযুক্ত সময়।
না, আমি হেরেমে যাবো না, মেয়েটিকে আমার শয়ন কক্ষে পাঠিয়ে দাও। দেয়ালে মশাল জ্বালা করিডোর দিয়ে মহিলাটি অন্দর মহলের দিকে চলে গেলো। সে একসময় হয়তো নিজেই খুব সুন্দরী ছিলো, হয়তো তার পিতার রক্ষিতাঁদের একজন। আকবর শুনেছেন মায়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের পূর্বে হুমায়ূন একজন মহা নারী-প্রেমিক ছিলেন এবং তাঁর বহু রক্ষিতা ছিলো।
পরিচারকদের বিদায় করে দিয়ে আকবর একা অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক অজানা উত্তেজনা এবং উৎকণ্ঠার মিশ্রণ তাকে নিষ্পেষণ করতে থাকলো। যতোই সময় গড়াচ্ছে ততোই তিনি অস্বস্তিতে আক্রান্ত হতে থাকলেন। তিনি ঠিক করলেন যে, হেরেমে খবর পাঠাবেন এই বলে যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু যেনো মুহূর্তে তিনি উঁচু দুভাগ বিশিষ্ট দরজার দিকে অগ্রসর হতে নিলেন, সেগুলি হঠাৎ খুলে গেলো এবং তার পরিচারক কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলো। সম্রাট, মেয়েটি এসেছে। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিনী বৃদ্ধাটি বলেছে সে রাজা তাল্ক এর সাবেক রক্ষিতা। রাজা তার খুব কদর করতেন এবং তাকে পাঠিয়েছেন এই আশা করে যে আপনাকেও সে পরিতৃপ্ত করতে পারবে। ওর নাম মায়ালা। আমি কি তাকে ভিতরে পাঠাবো?
আকবর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। এক মুহূর্ত পর একটি লম্বা, ছিপছিপে আকৃতি মাথা ঢাকা ঢিলে পোষাকে আবৃত অবস্থায় কক্ষে প্রবেশ করলো। তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। তার মাথার ঘোমটা এতো নিচু ছিলো যে তার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না। এগিয়ে এসে সে কুর্ণিশ করলো। আকবর একটু ইতস্তত করে আলতোভাবে তার হাত ধরে তাকে সোজা করলেন। মেয়েটি তার সম্মুখে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তিনি তার নরম ও দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ পেলেন। তিনি যখন তার ঘোমটাটি পেছনে ঠেলে দিলেন তার লম্বা কালো চুল রেশমের মতো তার মসৃণ কাঁধে ছড়িয়ে পড়লো, আকবর জেসমিন ফুলের গন্ধ পেলেন। সে তখনো নতমুখ ছিলো, আকবর তার চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুললেন।