যাদের আনুগত্য প্রশ্নবিদ্ধ তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় এ বিষয়ে লাহোরে আসার পথে আকবর বৈরাম খান এবং তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বহু সময় ধরে আলোচনা করেছেন। কেউ বলেছে তার পিতামহ বাবরের সময় এসব ক্ষেত্রে কোনো ক্ষমা প্রদর্শন করা হতো না। অপরাধীকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করা হতো অথবা তাদের হাত-পা ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে দুদিক থেকে টেনে দ্বিখণ্ডিত করা হতো। কিন্তু আকবর তারদি বেগের প্রতি তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের ফলাফল ভুলতে পারছিলেন না। এছাড়া তাঁর পিতা হুমায়ূন বলতেন, যে কোনো মানুষই প্রতিশোধ পরায়ণ হতে পারে। কিন্তু কেবল একজন মহান ব্যক্তিই ক্ষমাশীল হতে পারে।
আকবর তাঁর পিতার অনেক বিচার কাজ প্রত্যক্ষ করেছেন-এমনকি তার মা হামিদাও মনে করতেন যে তার পিতা কখনো কখনো অতিমাত্রায় দয়া প্রদর্শন করতেন। তবে আকবরের অনুভূতি বলে তাঁর পিতাই সর্বদা সঠিক ছিলেন। মোগলরা সর্বদাই নির্ভিক যোদ্ধা বলে বিবেচিত হবে এবং প্রয়োজনের সময় রক্ত ঝরাতে একটুও দ্বিধাগ্রস্থ হবে না। কিন্তু হিন্দুস্তানের মানুষের উপর শাসন ক্ষমতা বজায় রাখতে হলে তাদের ভীতি প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের শ্রদ্ধাও অর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত হত্যাকান্ড অতিমাত্রায় শত্রুতার জন্ম দেয়। বৈরাম খান গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার যুক্তি শ্রবণ করেছেন এবং শেষে একমতও হয়েছেন কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে সতর্কও করেছেন।
মনে রাখবেন, আপনার শত্রুদের চিনে রাখতে ভুল করবেন না এবং গুপ্তচরেরা যা বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আপনি ক্ষমা প্রদর্শনের পরেও যদি তারা বিশ্বাসঘাতকতা অব্যাহত রাখে তাহলে তাদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।
আকবর তাঁর মনকে আবার বর্তমানে ফিরিয়ে আনলেন। উপস্থিত কেউ সরাসরি তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলো না। তিনি অনুভব করলেন এই মুহূর্তে তাদেরকে সামান্য ভীতি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। আমি জানি কেনো আপনারা এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা বুঝতে পেরেছেন যুদ্ধের হাওয়া আমার অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি ভাগ্যের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি। আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন এবং এই ভূ-খণ্ডের উপর মোগলদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার পিতামহ বাবর এবং পিতা সেই অধিকার দৃঢ়ভাবে বজায় রেখেছিলেন এবং আমিও তার ব্যতিক্রম করবো না। যে কেউ আমার এই অধিকারের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করবে, তাকে ভয়ানক মূল্য দিতে হবে। যেমনটা হিমু দিয়েছে। আকবর একটু থামলেন তারপর দৃঢ়ভাবে পরিষ্কার কণ্ঠে আবার বলা শুরু করলেন, যদিও বহু প্রশংসা বাক্য এবং উপহার আপনাদের কাছ থেকে আমি লাভ করেছি, আমি জানি আপনাদের মধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। হয়তো এই মুহূর্তেও কারো কারো মনে ষড়যন্ত্র খেলা করছে। আপনারা সকলে আমার দিকে তাকান, যাতে আমি আপনাদের দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি।
ধীরে সকলে মাথা তুলে তাকালো, সকলের মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ, এমনকি যারা কোনো অপরাধ করেনি এবং সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলো তারাও আতঙ্কগ্রস্ত। আকবরের বয়স কম হলেও তিনি তার বাবার সংগ্রাম পর্যবেক্ষণ করে শিখেছিলেন যে অধিকাংশ মানুষই ক্ষমতা লোভী। তার সম্মুখে বিব্রতভাবে দাঁড়ানো অনেকেই তখন দরদর করে ঘামছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হিমুর বিদ্রোহের সময় মোগলদের উপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের কথা কল্পনাও করেনি।
আপনাদের মধ্যে অনেকে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন, সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমার রক্ষীরা আমার মুখ থেকে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণের অপেক্ষায় প্রস্তুত রয়েছে যার সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যায়দণ্ড কার্যকর করবে। তিনি লক্ষ্য করলেন গোত্রপতিদের দৃষ্টি বেদির দুদিকে অবস্থানরত কালো পাগড়িধারী এবং সবুজ জোব্বা পড়া লোকগুলির দিকে নিবদ্ধ হলো। লাহোরে পৌঁছানোর পর থেকেই আমি ভাবছি এবিষয়ে আমার কি করা উচিত… আকবর থামলেন। বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা লোকটি তখন কাঁপতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি এখনো তরুণ, আমার শাসনকালও তরুণ। এই মুহূর্তে আমি আর রক্ত ঝরাতে চাই না, তাই আমি ক্ষমাশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনাদের অতীতের সকল অপরাধ আমি ভুলে যাবো এবং আশা করবো এখন থেকে আপনারা আমার প্রতি অবিচলভাবে বিশ্বস্ত থাকবেন। যদি তা পারেন তাহলে আমি আপনাদের প্রতি সদয় থাকব। আর যদি না পারেন তাহলে কোনো শক্তিই আপনাদের আর রক্ষা করতে পারবে না।
আকবর উঠে দাঁড়ালেন, উপস্থিত গোত্রপতি এবং নেতারা তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আবারও মাথানত করলো, তিনি তাদের মাঝে স্বস্তির ভাব প্রত্যক্ষ করলেন। তিনি নিজের উপর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। তিনি স্পষ্টভাবে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার বক্তব্য শেষ করেছেন এবং তিনি নিজের প্রচণ্ড ক্ষমতাও উপলব্ধি করতে পারছেন। একটি মাত্র ইঙ্গিতে তিনি উপস্থিত যে কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যা করতে পারতেন। তিনি নিজে যেমন এটা জানতেন, তারাও সেটা জানতো। এই অনুভূতি তাঁকে পুলকিত করছিলো যে, যে কোনো মানুষের জীবনের গতি পরিবর্তনের ক্ষমতা তার রয়েছে। এজন্য তিনি ক্ষমাশীল হওয়ার প্রেরণাও অনুভব করলেন।