এই সফর আকবরের মনোবাসনা পূরণ করতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। প্রিয় কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটির সোনা মোড়ান জিনে বসে লাগাম ধরে, পিতার ঝলমলে বক্ষ-বর্ম এবং তলোয়ার নিয়ে নিজ সাম্রাজ্য প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁর নিজেকে ভীষণ শক্তিশালী এবং গর্বিত মনে হয়েছে। তাঁর পাশে ছিলেন বৈরাম খান এবং পেছন থেকে তাঁদের অনুসরণ করছিলো সেইসব সেনাপতি যারা হিমুর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মাঝে তাঁর দুধভাই আদম খানও ছিলো। এই দলের পিছনে রণ তূর্য এবং ঢাক বাজিয়ে এগিয়ে আসছিলো তার অশ্বারোহী সৈন্যরা। তাঁদের হাতে ছিলো সবুজ পতাকা এবং ইস্পাতের ফলা যুক্ত উঁচিয়ে ধরা বর্শা। অশ্বারোহী বাহিনীকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসছিলো তীরন্দাজ বাহিনী, বন্দুকধারী সৈন্য এবং গোলন্দাজ বাহিনী। তাঁদের কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে আর বাকিরা পায়ে হেঁটে।
তীরন্দাজ, বন্দুকধারী এবং অশ্বারোহীদের পেছনে এগিয়ে আসছিলো বড় বড় টানা গাড়ি। সেগুলিতে ঠাসা ছিলো হিমুর শিবির থেকে বাজেয়াপ্ত করা মুদ্রা, অলঙ্কারের সিন্দুক এবং রেশমী বস্ত্রের গাঁট- একদল বিশিষ্ট রক্ষী সেগুলির পাহারায় নিযুক্ত ছিলো। তাঁদের থেকে প্রায় পৌনে একমাইল পেছনে ছিলো আকবরের যুদ্ধ-হাতির দল, কারণ সেগুলি সম্মুখে থাকলে তাদের পদাঘাতে সৃষ্ট ধূলিমেঘ সম্রাটের গতিপথ আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে। হাতিগুলি এখনো যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম পড়ে আছে, তাঁদের দাঁতে এখনো শোভা পাচ্ছে বাঁকা ফলা যুক্ত খঞ্জর, প্রদর্শনীর জন্য। হিমুর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হাতিগুলি নিয়ে আকবরের হাতি সংখ্যা এখন ছয়শোর উপরে দাঁড়িয়েছে। তাদের পিছনে ছিলো কামান বহনকারী ষড়টানা গাড়ি। সর্বশেষে ছিলো তাবু, তৈজসপত্র, খাদ্য এবং জ্বালানী বহনকারী গাড়িবহর-রাজকীয় শিবির স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু তাতে মজুত ছিলো।
সর্বত্রই উৎসুক জনতা তাদের একনজর দেখার জন্য এমন ধাক্কাধাক্কি করছিলো যে রক্ষীরা তাঁদের ঠেকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলো। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও লোকজন ছুটে আসছিলো তাদের জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করার জন্য এবং সম্রাটকে তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করার জন্য। আকবরের ইচ্ছা ছিলো লাহোরে এসে এই মহড়ার সমাপ্তি টানা-অবশেষে তাই সেখানে পৌঁছে তিনি সন্তুষ্ট বোধ করলেন। লাহোর হলো সেই শহর যেখানে দুই বছর পূর্বে ১৫৫৬ সালের এক স্নিগ্ধ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর পিতা হুমায়ূন হিন্দুস্তান পুনরায় জয় করার অভিযানে যাওয়ার সময় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। আকবর তাঁর সঙ্গেই ছিলেন এবং তখনকার সবকিছু তার স্পষ্ট মনে আছে।
নিজ পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আকবর পুনরায় একই সাজে লাহোরের প্রবেশপথ সাজানোর আদেশ দেন। এই মুহূর্তে উঁচু সিংহাসনে বসে নিচে সারিবদ্ধভাবে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা গোত্রপতি এবং রাজাদের দিকে তাকিয়ে তিনি গভীর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। হিমু তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তারা যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে তাঁর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারেনি। প্রতিদিন তাদের প্রেরিত দূতেরা তাঁদের কাছ থেকে বাহারী প্রশংসা বাক্য এবং অপরিমিত উপহার বয়ে নিয়ে এসেছে- শিকারী কুকুর, রত্নহার পরিহিত ঘুঘু পাখি, রংধনু বর্ণিল পালক, পান্নাখচিত ছোরা, হাতির দাঁতে বাধাই করা গাদাবন্দুক, পদ্মরাগমণি খচিত বাতিদান, কাছিমের খোলে তৈরি বাক্সে ভরা সুগন্ধী প্রভৃতি। এমনকি একটি খুব বড় আকারের চুনি পাথরও তিনি উপহার হিসেবে পেয়েছেন যেটা উপহারদাতার পরিবারের কাছে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে ছিলো।
এই সব উপহার তিনি উদার চিত্তে গ্রহণ করেছেন কিন্তু ইতোমধ্যেই তিনি এমনটা বোঝার মতো যথেষ্ট বিচক্ষণতা অর্জন করেছেন যে, উপহার যতো বেশি মূল্যবান উপহার দাতার বিশ্বাসঘাতকতাও ততোই মারাত্মক। বৈরাম খানের সঙ্গে পরামর্শ করে আকবর এই সব আপাতদৃষ্টিতে অনুগত মিত্রদের লাহোরে তার সঙ্গে সাক্ষাত করার আদেশ দেন।
সকলে উঠে দাঁড়ান।
তারা সংখ্যায় প্রায় ষাট জনের মতো হবে, কেউ মসৃণ চকচকে চেহারার, কেউবা হৃষ্টপুষ্ট, রেশম এবং রূপার কারুকাজ করা জোব্বা বা আলখাল্লা পড়ে আছে, সেগুলির রং নীলার নীল থেকে শুরু করে জাফরানী হলুদ পর্যন্ত সকল বর্ণে বর্ণিল-কেউ কেউ পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি, তারা মোটা হাতে বোনা কাপড়ের আলখাল্লা ও পাজামা পড়ে রয়েছে, সকলে উঠে দাঁড়ালো। তাদের হাত করোজোড়বদ্ধ এবং মাথা নিচু।
আমার হুকুম পালন করার জন্য এবং আমার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অল্প সময় আগে আমার পিতা লাহোর অতিক্রম করার সময় আপনারা তাঁকে যে আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন সে ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আপনাদের অনেকের চেহারাও আমি চিনতে পারছি। আকবর তাদের সকলের উপর একবার দৃষ্টি বুলালেন। বৈরাম খান এখানে আকবরের কি করা উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আগেই বুঝিয়েছেন। আকবর জানতেন এই গোত্রপতিদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কমপক্ষে দশজন রয়েছে যারা তাঁর পিতার প্রতি অনুগত্যের শপথ নিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে দুইজন হিমুর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। তারা হয়তো ভাবছে আকবর তাঁদের কর্মকান্ড সম্পর্কে কতোটা জানেন? কাছাকাছি অবস্থিত মুলতান থেকে আগত ঐ বসন্তের দাগ বিশিষ্ট ভুড়িওয়ালা গোত্রপতিটি, যে একটু আগে তাকে একটি বাদামী রঙের চমৎকার স্ট্যালিয়ন ঘোড়া উপহার দিয়েছে এবং এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের নিচে থাকা শতরঞ্জির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে, সেকি জানে আকবরের কাছে তার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ রয়েছে? আহমেদ খানের লোকেরা তার একজন দূতকে আটক করে যে হিমুর কাছে তার পাঠানো একটি চিঠি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।