তরুণটিকে বন্দী করো, বৈরাম খান আদেশ দিলেন। সাথে সাথে দুজন লম্বা দেহের দেহরক্ষী তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো এবং দুদিক থেকে তরুণটির বাহু জাপটে ধরে তাকে আহত লোকটার কাছ থেকে সরিয়ে আনলো। এইবার আকবর আহত লোকটিকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন। যেখানে তার বাম চোখটি ছিলো সেখানে একটি তীরের অগ্রভাগ বিধে আছে এবং তীরটির বাকি অংশ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তার মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে নিশ্চয়ই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে, কিন্তু মনে হলো তার যন্ত্রণা উধাও হয়েছে যখন আকবর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি হিমু?
নিশ্চয়ই। আর কে হতে পারে?
তোমার ন্যায়সঙ্গত সম্রাটকে তোমার কি বলার আছে?
আমি বলতে চাই আমার কোনো ন্যায়সঙ্গত সম্রাট নেই এবং আমি তোমাকে ঘৃণা করি মোগল অনুপ্রবেশকারী। হিমু আকবরকে লক্ষ্য করে একপ্রস্থ রক্তাক্ত থুথু ছুঁড়ে দিলো কিন্তু তা আকবরের কাছে পৌঁছালো না।
এখনই তাকে হত্যা করুন, সম্রাট, বৈরাম খান বললেন।
আকবর তার তলোয়ার উঠালেন কিন্তু কোনো কারণে তিনি আহত লোকটাকে আঘাত করতে ইতস্তত করলেন। এটা ঠিক হবে না বৈরাম খান। আমার বাবা আমাকে সর্বদাই বলতেন হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার তুলনায় ক্ষমাই একজন সম্রাটের জন্য বেশি মর্যাদাকর…
একথা শুনে হিমু অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো এবং আকবরের দিকে এগিয়ে এলো। কিন্তু আকবরের দুজন রক্ষী সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেললো। কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র খ্যাতি ও মারাত্মক জখম যেনো তাকে হঠাৎ ভীষণ বল প্রদান করলো, হিমু প্রচণ্ডভাবে মোচড় খেয়ে এক মুহূর্তের জন্য রক্ষীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলো। টলমল পায়ে আকবরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে চিৎকার করে বললো, তোমরা আমাদের ভূ-খণ্ডকে কলুষিত কত ছো। তুমি স্বৈরাচারী তৈমুরের বংশধর, তুমি নিশ্চিতভাবে জানো না কে তোমার বাবা। আমি শুনেছি তোমার বাবা তোমার মাকে তার সেনাপতিদের ভোগে ব্যবহার করতে বেশ্যার মতো, যাতে তারা তার প্রতি অনুগত থাকে এবং তোমার মা- উট-মুখো বেশ্যা, সেটা উপভোগও…
হিমু আর কিছু বলতে পারলো না। তলোয়ারের এক কোপে আকবর তার ধড় থেকে মস্তক আলাদা করে দিলেন। ক্রোধে তার সর্বাঙ্গ থরথর করে। কাঁপছে, তার মুখ হিমুর ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত। কয়েক মুহূর্ত তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না, কিন্তু তারপর তিনি তলোয়ার কোষবদ্ধ করে মুখের রক্ত মুছলেন এবং বৈরাম খানের দিকে ফিরলেন। শান্ত গলায় বললেন, আপনার কথাই ঠিক। অযোগ্য ব্যক্তিকে আমাদের ক্ষমা প্রদর্শন করা উচিত নয়। ঐ নোংরা প্রাণীটির দেহটাকে শিবিরে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করুন। আর ওর মাথাটা দিল্লীতে পাঠান, কোনো জনসমাবেশে সেটা ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দিন। অন্যান্য প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহীদের জন্য সেটা একটা ভয়াবহ নিদর্শন হয়ে থাকুক।
আকবর বৈরাম খানকে নিয়ে শিবিরে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরলেন, এসময় আদম খান তাঁদের দিকে এগিয়ে এলো। তার বাম হাতের আঙ্গুলে পট্টি বাঁধা। তুমি খুব ভালো লড়েছো দুধ-ভাই। আমি তোমার রণনৈপুণ্য দেখেছি।
শুনলাম তুমিও রক্তের স্বাদ লাভ করেছো, হিমুর দেহরক্ষী প্রধানকে হত্যা করে। কিন্তু একটি দুঃসংবাদ আছে। তারদি বেগ নিহত হয়েছেন।
কি?…কীভাবে উনি মারা গেলেন?
যখন তুমি আমাকে নির্দেশ দিলে তার সৈন্যদের অতঙ্কে পালানোর অভিনয় করিয়ে তোমার দিকে নিয়ে আসার তখন আমি এবং আমার সঙ্গীরা লড়াই করতে করতে তারদি বেগের অবস্থানে পৌঁছাই। আমরা দূর থেকে দেখতে পাই কয়েক জন ছাড়া তার অধিকাংশ দেহরক্ষীই মাটিতে লুটিয়ে আছে, আহত অথবা নিহত। সে নিজে ঘোড়া হারিয়ে ভূমিতে অবস্থান করছে এবং তাকে ঘিরে থাকা হিমুর যোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণপণে লড়াই করছে। আমরা যখন তাকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যাই শুনতে পাই শত্রু যোদ্ধারা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলছে। কিন্তু সে চিৎকার করে বললো, না! আমি একজন মর্যাদাবান মানুষ, আমার সাম্রাজের প্রতি বিশ্বস্ত। আমি দেখলাম শেষ বারের মতো তিনি তার শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন এবং একজন শত্রু একটি বর্শা তার পেটে ঢুকিয়ে দিলো। আরেকজন হিমুর যোদ্ধা তার মাথা টেনে ধরে পশুর মতো তাকে জবাই করলো।
তুমি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছ, তারদি বেগ, আমার ভাই, আমার তুগান। আজ রাতেই যেনো তোমার আত্মা জান্নাত লাভ করে এই কামনা করছি, বৈরাম খান বিড়বিড় করে বললেন। তোমাকে সন্দেহ করার জন্য আমি দুঃখিত।
দীর্ঘ বিরতির পর আকবর বৈরাম খানের সঙ্গে কথা বললেন। তারদি বেগকে শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড প্রদান না করাটাই আমাদের জন্য উত্তম সিদ্ধান্ত ছিলো, তাই না? হিমুকে ক্ষমা প্রদর্শন করা ভুল ছিলো কিন্তু তারদি বেগকে মার্জনা করে আমরা তাকে তার হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারের সুযোগ দিতে পেরেছি। আমার পিতা সঠিক ছিলেন, কি বলেন? ক্ষমা এবং নিষ্ঠুরতা উভয়ই একজন মহান শাসকের জন্য উপযুক্ত।
জ্বী সম্রাট, বৈরাম খান বললেন এবং আকবর দেখলেন তার প্রধান সেনাপতির গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
.
০৩. বয়সের পূর্ণতা
লাহোরের দুর্গপ্রাসাদের মার্বেল পাথরের মঞ্চ থেকে আকবর নিচের দিকে তাকালেন। তিনি উঁচু পৃষ্ঠদেশ বিশিষ্ট সোনার সিংহাসনে বসে ছিলেন। বৈরাম খানের পরামর্শে হিমুর কোষাগারে সঞ্চিত স্বর্ণমুদ্রা গলিয়ে সিংহাসনটি নির্মাণ করা হয়েছে। গত ছয়মাস ধরে হিন্দুস্তানের যেখানেই। তিনি অবস্থান করেছেন সেখানেই সিংহাসনটি বয়ে নেয়া হয়েছে। প্রথম যুদ্ধ জয়ের পর প্রজাদের সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করার বুদ্ধিটি তার নিজেরই, কিন্তু বৈরাম খানের পরামর্শে এই মোগল শক্তি প্রদর্শনের উদ্যোগ আরো চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছে।