আকবর তার পরিকল্পনা অনুমান করতে পারলেন, তিনি শেষ মুহূর্তে একপাশে সরে গেলেন কিন্তু সেনাকর্তাটির তলোয়ারের অগ্রভাগ তার গলার কণ্ঠমণির (এ্যাডামস এ্যাপেল) ঠিক উপরে আঁচর কেটে ঘুরে গেলো। কিন্তু আকবর সেটা খেয়াল করলেন না। তিনি তাঁর তলোয়ারটি সেনাকর্তাটির ডান বগল বরাবর গভীরে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিলেন, আকবরের গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালানোর সময় শত্রুর ঐস্থানটি অরক্ষিত হয়ে পড়েছিলো। যোদ্ধাটি তার ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে পড়ে স্থির হয়ে রইলো, তার বাহুসন্ধি থেকে পাথুরে মাটির উপর কালচে লাল রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিলো। দরদর করে ঘামতে থাকা আকবর বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। নিজ প্রাণ রক্ষা করতে পেরে তিনি অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করলেন এবং নিজের চারদিকে নজর বোলালেন। দেখলেন তাঁর দেহরক্ষীরা সেনাকর্তাটির অন্য সঙ্গীদের হত্যা করেছে। অল্প দূরে হিমুর কিছু সৈন্য তাঁদের ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, বাকিরা আত্মসমর্পণ করছে।
আকবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং কমলা পাগড়ী পড়া সেনাকর্তাটির দিকে ছুটে গেলেন। সে তখনো বেঁচে ছিলো। তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে একহাতে তিনি তার মাথাটি তুললেন। তুমি খুব ভালো লড়েছ আকবর তাকে বললেন।
আমি আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আমি আপনার উপর আমার প্রভু হিমুর পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম, সেনাকর্তাটি উত্তর দিলো। সে খুব কষ্ট করে কথা বলছে।
হিমুর পক্ষ থেকে আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে? তুমি কি বোঝাতে চাইছো?
আহত লোকটি ঘরঘর শব্দ করে শ্বাস নিলো এবং কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু প্রথমে তার মুখ দিয়ে কথা নয়, রক্ত বেরিয়ে এলো। অবশেষে সে বলতে পারল, আমরা আপনার ডান-পার্শ্বস্থ সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করার ঠিক পরপরই আপনার সেনাদের ছোঁড়া একটি তীর আমার প্রভুর চোখে ঢুকে তাকে আহত করে। তিনি এখান থেকে সামান্য দূরে আমার সমমর্যাদার কিছু ব্যক্তিগত রক্ষীর তত্ত্বাবধানে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। লোকটির মুখে আবার রক্ত উঠে এলো এবং তার মাথাটি একদিকে নেতিয়ে পড়লো। স্পষ্ট বোঝা গেলো সে মারা গেছে। আকবর তাকে যত্নের সাথে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। ইতোমধ্যে তার রক্ষীরা তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাঁদের বললেন, এই লোকটির ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করো। যদিও প্রভু নির্বাচনে সে ভুল করেছে, সে একজন উত্তম যোদ্ধা ছিলো।
আকবর বুঝতে পারলেন তিনি বিজয়ী হয়েছেন, তার ধূলিমাখা মুখে চওড়া আকৃতির হাসি ফুটে উঠলো। তিনি তাঁর প্রথম পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। তার ভবিষ্যৎ-মহান সম্রাটের ভবিষ্যৎ-নিশ্চিতভাবেই উজ্জ্বল। তার পরবর্তী অভিযানগুলি হবে সাম্রাজ্য বিস্তারের লড়াই। আকবর বৈরাম খানকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন কিন্তু কাছে আসার পর লক্ষ্য করলেন তার চেহারায় বিজয়ের উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত।
আকবর, কেনো আপনি লড়াই এ যোগ দিলেন যখন আমি আপনাকে পেছনে থেকে যুদ্ধে নির্দেশনা প্রদানের পরামর্শ দিলাম? বৈরাম খান কোনো আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন ছাড়াই শুষ্ক কণ্ঠে বললেন।
আকবরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো, তিনি তীব্র ক্রোধ অনুভব করলেন। তিনি একজন সম্রাট। যদিও বৈরাম খান তার অভিভাবক এবং প্রধান সেনাপতি, কিন্তু তিনি তার সঙ্গে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা কোথায় পেলেন? এভাবে তার বিজয়ের মুহূর্তটিকে মাটি করে দিলেন। এটাতো সম্রাট হিসেবে তার প্রথম যুদ্ধ! তার পিতামহ বাবর তাঁর মতো বয়সেই নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর, তিনি উপলব্ধি করলেন বৈরাম খানের কাছে তিনি কতোটা ঋণী। তিনি তার ক্রোধ সংবরণ করে শান্ত গলায় বললেন, আপনি কি এমন একজন ব্যক্তিকে সম্রাট হিসেবে গ্রহণ করবেন, যে যুদ্ধ ক্ষেত্রের ভয়াবহতার মাঝে টগবগে রক্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিবর্তে কাপুরুষের মতো শীতলতা অনুভব করবে?
এবার বৈরাম খানের মুখমণ্ডল থেকে কঠোরতা সরে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। না সম্রাট, অবশ্যই না।
ঐ সেনা কর্মকর্তাটি মৃত্যুর আগে আমাকে জানিয়েছে মৃত হাতিগুলির আড়ালে কোথাও আহত হিমু পড়ে আছে। চলুন আমরা অনুসন্ধান করে দেখি।
উন্মুক্ত তলোয়ারধারী দেহরক্ষীদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবস্থান নিয়ে আকবর এবং বৈরাম খান মাটিতে পড়ে থাকা মৃত হাতিগুলির দিকে হেঁটে গেলেন। কামানের গোলার আঘাতে যে হাতিগুলির নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছিলো সেগুলি থেকে তখন উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আকবর এবং বৈরাম খান একটি হাতিকে অতিক্রম করার সময় হঠাৎ সেটি যন্ত্রণায় মাথা ঘুরালো এবং ঔড় দিয়ে মাটিতে আঘাত করলো। নিজের অজান্তেই আকবর তলোয়ারের দিকে হাত বাড়ালেন কিন্তু দেখলেন ঘাড়ের উপর বিশাল ক্ষত নিয়ে প্রাণীটি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
হাতিটাকে তার মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রেহাই দাও, তিনি একজন দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন। এবং আহত অন্যান্য হাতিগুলির একই ব্যবস্থা করো। এই আদেশ প্রদানের সময় আকবর লক্ষ্য করলেন সামান্য দূরে বিধ্বস্ত একটি কারুকার্য খচিত হাওদার পাশে একজন তরুণ যোদ্ধা মাটিতে শুয়ে থাকা ছোটখাট আকৃতির একজন ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে আছে। মাটিতে শুয়ে থাকা ব্যক্তিটির মিনা করা নক্শা শোভিত বর্ম দেখে বোঝা গেলো সে হিমু ছাড়া আর কেউ নয়। তরুণটি একটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে তার মুখের বাম পাশটা মুছে দিচ্ছে আর লোকটি তাকে চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখানেই মরতে দাও। কিছুদিন পর কোনো মোগল কয়েদখানায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করাই আমার জন্য সম্মানজনক হবে।