তীর চালাও! যুদ্ধক্ষেত্রের গোলযোগ ছাড়িয়ে বৈরাম খানের আদেশ শোনা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে হিমুর বাহিনীর উপর বৃষ্টির মতো তীর বর্ষিত হতে লাগলো। আকবর দেখলেন হওদার উপর থেকে শত্রুবাহিনীর বহু সৈন্য হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে। একটি হাতি সেটার চোখের ঠিক নিচের অরক্ষিত অংশে তীর বিদ্ধ হয়ে সেটার পাশে থাকা আরেকটি হাতির দিকে হেলে পড়ে সেটার পথরোধ করে দিলো। তখনই দ্বিতীয়বার কামান দাগার ফলে চারদিক অবার ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হয়ে উঠলো এবং বিস্ফোরণের শব্দে আকবর কয়েক মুহূর্তের জন্য সম্পূর্ণ কালা হয়ে গেলেন। তিনি আদেশ দিতে থাকা বৈরাম খানের মুখ নড়তে দেখলেন কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। ধোঁয়া সরে গেলে তিনি বুঝতে পালেন বৈরাম খান কি আদেশ দিচ্ছিলেন। তার তীরন্দাজেরা শেষবারের মতো একযোগে তীর নিক্ষেপ করলো এবং আকবরের যুদ্ধহাতি ও আশ্বারোহী সৈন্যরা হিমুর বিশৃঙ্খল সেনাদের দিকে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করতে ছুটে গেলো। তাঁর হাতিগুলির পিঠে থাকা সবুজ পাগড়ি পড়া বন্দুকধারীরা গুলি ছুড়ছে। হিমুর হাতির পিঠে থাকা এক মাহুত গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সে মুচড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আগানোর চেষ্টা করলো একবার, তারপর স্থির হয়ে গেলো।
আরেকদিকে আকবর দেখলেন একজন মোগল অশ্বারোহী কেবল একটি বর্শা নিয়ে অসীম সাহসে হিমুর একটি বিশাল যুদ্ধ-হাতিকে আক্রমণ করলো। একহাতে লাগাম ধরে থেকে অন্যহাতে সে বর্শাটি হাতিটির চোয়ালের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিলো। হাতিটির মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো এবং সেটি ঘুরে পেছন দিকে দৌড় দিলো।
আকবর এই মুহূর্তে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন এবং আদম খান এর বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে অতিক্রম করে যুদ্ধে নিজের ভূমিকা রাখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন। তিনি তার অবস্থান থেকে অল্প দূরে আদম খানের রণনৈপুণ্য দেখতে পাচ্ছিলেন। বৈরাম খান, আমরা কি এখন লড়াইএ প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারি না?
না, আপনি আপনার ধৈর্য বজায় রাখুন। একজন ভালো সেনাপতি অথবা একজন কৌশলী সম্রাটকে বুঝতে হবে কোনো মুহূর্তটি তার আক্রমণ করার জন্য আদর্শ। এই মুহূর্তে পেছনে থেকে আমাদের আক্রমণের ফলাফল বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তলোয়ারের পাশাপাশি উত্তম বুদ্ধি এবং কৌশলও যুদ্ধ জয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেখুন হিমুর বাহিনী কেমন বিভ্রান্ত, তাদের আক্রমণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
আমরা এই সুযোগ কীভাবে কাজে লাগাতে পারি এবং হিমুর বাহিনীকে ধ্বংস করে পারি? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর মন আক্রমণে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া অন্যকোনো পরামর্শ মানতে চাইছে না।
এখন আমাদের বামপার্শ্বের সৈন্যদের সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দিতে পারি, তারা যেনো শত্রুদের ঘিরে ফেলতে পারে। যেহেতু তারা এখনো যুদ্ধে পুরোপুরি অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি ফলে তারা অধিক সতেজ এবং উৎসাহী হয়ে আছে। এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারলে ওদের সহায়তায় নিশ্চিতভাবেই আমরা বিজয়ী হবো যখন কিছু সময় আগে আমরা পরাজয়বরণ করতে যাচ্ছিলাম। যুদ্ধে এমনটাই ঘটে।
আকবরের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে বৈরাম খান হুকুম দিলেন। নির্দেশ পেয়ে তাঁদের অশ্বারোহী সেনারা হস্তীবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে শত্রুদের ঘিরে ফেলতে এগিয়ে গেলো। ইতোমধ্যে হিমুর একদল অশ্বারোহী সেনা পালানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। তাঁদের কেউ কেউ থেমে তাঁদের দলের মাটিতে পড়ে থাকা আহত যোদ্ধাদের তুলে নেয়ার চেষ্টা করছে। আকবর দেখলেন হিমুর প্রায় বিশটি হাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাদলও পালায়ন শুরু করেছে। তাঁদের বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজেরা পেছন থেকে তখনো গুলি এবং তীর ছুড়ছে। কেউ কেউ অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছে।
সেই সময় প্রায় আধ মাইল দূরে হিমুর সৈন্য দলের প্রায় একহাজার অশ্বারোহী সৈন্যকে কিছু ভূ-লুষ্ঠিত হাতিকে ঘিরে সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গেলো। হাতিগুলির মৃতদেহকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলো এবং মোগল বাহিনীকে পিছু হটানোর চেষ্টা করছিলো। আকবর অনুভব করলেন এখনো তার বিজয় অর্জিত হয়নি।
বৈরাম খান কিছু বলতে পারার আগেই আকবর তার ঘোড়ার পেটে লাথি মেরে সেই দিকে তীব্র বেগে ধাবিত হলেন। তিনি যখন সেই স্থানের কাছাকাছি পৌঁছালেন তার দেহরক্ষীরাও তাকে অনুসরণ করে সেখানে উপস্থিত হলো। হিমুর কিছু যোদ্ধা আকবরকে চিনতে পারলো। কমলা পাগড়িধারী এক সেনাকর্তার নেতৃত্বে তারা মৃত হাতিগুলির আড়াল থেকে বের হয়ে আকবরকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।
আকবর দিক পরিবর্তন না করে তাদের দিকেই ঘোড়া ছোটালেন, তার রক্তে তখন লড়াই এর উন্মাদনা। মোগলদের ছোঁড়া গুলিতে শত্রু পক্ষের কয়েকজন ধরাশায়ী হলো কিন্তু সেনাকর্তাটি অক্ষত অবস্থায় এগিয়ে এলো। এই মুহূর্তে আকবর তার দেহরক্ষীদের কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে চলে গেছেন। তিনি তার তলোয়ারটি সম্মুখে প্রসারিত করে সেনাকর্তাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। যোদ্ধাটি হঠাৎ একপাশে সরে গিয়ে আকবরকে লক্ষ্য করে তার তালোয়ার চালালো, আকবর তখন অনেকটা অরক্ষিত। তার তলোয়ারের ফলা আকবরের শিরোস্ত্রাণ (হেলমেট) ছুঁয়ে ঘুরে যাওয়ার সময় সেটায় যুক্ত ময়ূরের পলকটি দ্বিখণ্ডিত করলো। তারা উভয়ে তীক্ষ্ম বাঁক নিয়ে আবার পরস্পরের দিকে ছুটে এলো। এইবার যোদ্ধাটির চালানো তলোয়ার আকবরের বক্ষ-বর্মের উপর আচড় কেটে বেরিয়ে গেলো এবং এই আঘাতে তিনি একপাশে কাত হয়ে গেলেন। তার একটি রেকাব (পাদানী) ছুটে গেলো এবং কোনোক্রমে তিনি ঘোড়ার পিঠ আকড়ে থাকলেন। হিমুর সেনাকর্তাটি আবার আক্রমণ করার জন্য তার ঘোড়াটি ঘুরিয়ে নিলো। তার আঘাত ফলপ্রসূ হচ্ছে এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে দ্রুত লড়াইটার ইতি টানার জন্য তড়িৎ বেগে সে আকবরের দিকে ছুটে এলো এবং তার মস্তক বিচ্ছিন্ন করার জন্য গলা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো।