হুমায়ুনের চাহনী তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর উপর দিয়ে ভেসে বেড়ায়। কয়েকদিন আগে, আমি আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারি। আমার সৎ-ভাইয়েরা আমাকে অপহরণের এবং বলপ্রয়োগ করে আমার সাম্রাজ্যের কিছুটা আদায়ের পরিকল্পনা করেছে- সম্ভবত তারা আমাকে হত্যাই করতে চেয়েছিল। তার অমাত্যদের আদতেই বিক্ষুব্ধ দেখায়। হুমায়ুন ভাবে, তাদের ভিতরে কতজন অভিনয় করছে। কয়েকজন, অবশ্যই, ষড়যন্ত্রের কথা আগে থেকেই জানতো, এমনকি নিরব সমর্থন দিয়েছে। উপজাতীয় গোত্রপতিদের কয়েকজন যারা হিন্দুস্তান বিজয়ের অভিযানে বাবরের সাথে ছিল কখনই তাদের নতুন বাসস্থানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। এই নতুন ভূখন্ত্রে বৈচিত্র্যহীন, আপাতদৃষ্টিতে শেষ না হওয়া সমভূমি, এখানকার বাতাসের উষ্ণতা আর তার সাথে প্রবাহিত বালুকণা এবং অঝোর ধারায় সিক্ত করা বর্ষাকাল তারা অপছন্দ করতো। তারা গোপনে অন্তরে লালন করতো, বরফাবৃত পাহাড় এবং খাইবার গিরিপথ আর তার ওপারে তাদের মাতৃভূমির শীতল স্রোতস্বিনীর জন্য তাদের ভেতরে একটা আকুতি ছিল। তাদের ভিতরে অনেকেই হয়তো ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে গোপনে সহযোগিতা করার এই সুযোগকে স্বাগতই জানিয়েছিল যার ফলে তারা হয়তো বেশ ভালো রকমের ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবে। বেশ, এখন ব্যাটারা উৎকণ্ঠায় একটু ঘামলে মন্দ কি…
আমার গুণধর ভাইদের আমার সামনে এনে হাজির কর যাতে করে তাদের সহযোগিদের বিষয়ে আমি তাদের প্রশ্ন করতে পারি।
হুমায়ুন আর তার অমাত্যের দল যখন অপেক্ষা করে চারপাশে সমাধি গর্ভের পরম নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। অবশেষে, দরবার কক্ষের বাইরের আঙিনায় পাথরের মেঝেতে ধাতব শেকলের ঘষা খাবার শব্দে এই অস্বস্তিকর নিরবতার সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ুন মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে প্রহরীদের দ্বারা প্রায় ছেড়ে নিয়ে আসার ভঙ্গিতে টলতে টলতে তার ভাইয়েরা সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করছে। প্রথমেই রয়েছে কামরান, তার পাতলা ঠোঁট আর বাজপাখির মতো নাক বিশিষ্ট মুখাবয়বে পরিষ্কার তাচ্ছিল্য ফুটে আছে। তার পায়ে হয়ত শেকল পরান হয়েছে কিন্তু তার স্পর্ধিত মস্তক বহনকারী দেহটার ভঙ্গিমায় স্পষ্ট বোঝা কোনো প্রকারের ক্ষমা প্রার্থনার অভিপ্রায় তার নেই। আসকারির, খর্বকায় আর হাল্কাপাতলা, ব্যাপারটা আবার একেবারেই ভিন্ন। তাঁর দাড়ি না কামানো মুখের ভাঁজে ভাঁজে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং তার কালো র নীচের ছোট ছোট চোখ দুটো সকাতরে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হিন্দাল, তার বড় দুভাইয়ের পেছনে প্রথমে প্রায় ঢাকা পড়ে ছিল, মাথা ভর্তি একরাশ জটপাকান কালো চুলের নীচে তার কিশোর মুখাবয়বে ভয়ের চেয়ে কেমন বোধহীন শূন্য একটা অভিব্যক্তি যেন যা কিছু ঘটতে চলেছে সবকিছুই তার বোধগম্যতার বাইরে।
তাদের কাছ থেকে প্রহরীরা সরে যেতে, আসকারি আর হিন্দাল, প্রথাগত অভিবাদন কুর্নিশ এর রীতি অনুসারে নিজেদের হুমায়ুনের সামনে প্রণিপাতের ভঙ্গিতে আনত করে। আসকারি বেশ কিছুটা সময় ইতস্তত করার পরে, মুখে একটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে তুলে একই কাজ করে।
উঠে দাঁড়াও।
তিনজনের প্রত্যেকের উঠে দাঁড়াবার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস শেষ না হওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন চুপ করে থাকে। এখন সে আরও ভালোও করে খুটিয়ে তাঁদের অভিব্যক্তি যাচাই করতে পারে সে দেখে যে কামরানের মুখের একপাশে একটা কালশিটের দাগ রয়েছে।
নিজেদের কার্যকলাপের জন্য তোমরা কি সাফাই দেবে? তোমরা প্রত্যেকে আমার সৎ-ভাই। আমার বিরুদ্ধে কেন তোমরা ষড়যন্ত্র করতে গেলে?
আমরা কিছুই করিনি…এটা মোটেই সত্যি নয়… উদ্বিগ্ন আর কর্কশ, আসকারির কণ্ঠস্বর মোটেই প্রত্যয়দীপ্ত নয়।
তুমি মিথ্যাচার করছে। তোমার চোখে মুখে সেটা স্পষ্ট ফুটে আছে। তুমি আবারও সে চেষ্টা কর, আমি বাধ্য হব তোমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে। কামরান, এদের ভিতরে যেহেতু তুমিই সবার বড়, আমার প্রশ্নের উত্তর তুমিই দাও। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা কেন করতে গেলে?
কামরানের চোখ- তাদের মরহুম আব্বাজান বাবরের চোখের মতোই সবুজাভ দীপ্তিময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হুমায়ুনের দিকে সে যখন মুখ তুলে তাকায়, কুচকে সরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রের ধারণাটা আমার মস্তিষ্কপ্রসুত শাস্তি দিতে হলে আমাকে দাও, ওদের নয়। আমাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সেটা সংশোধন করার এটাই একমাত্র পথ। তুমি নিজেই বলেছে যে আমরা সবাই বাবরের সন্তান। আমাদের সবার ধমনীতেই কি তৈমূরের রক্ত বইছে না? আর সেই সাথে আমাদের নানীজান খুতলাঘ নিগারের কারণে চেঙ্গিস খানের রক্ত? অথচ দেখো তোমার চামচা করে আমাদের রাখা হয়েছে, তোমার মর্জিমাফিক এদিক সেদিক বিনাবাক্যব্যয়ে ছোটার জন্য। শাহজাদা নয়, ক্রীতদাসের মতো তুমি আমাদের সাথে আচরণ কর।
আর তোমরা তোমাদের সবাই, কেবল কামরান একা না- ভাইয়ের মতো না, বরং ছিঁচকে অপরাধীর মতো আচরণ করেছে। আমার প্রতি নয় নাই থাকলো, কিন্তু আমাদের রাজবংশের প্রতিও কোনো আনুগত্যবোধ তোমাদের ভিতরে নেই? তার সিংহাসনের ডানপাশের দেয়ালের অনেক উঁচুতে স্থাপিত কাঠের সূক্ষ কারুকাজ করা জাফরির দিকে হুমায়ুন আড়চোখে তাকালে, নিমেষের জন্য একজোড়া কালো চোখ সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে খানজাদা, আর সম্ভবত তার আম্মিজান মাহাম জাফরির পেছনে অবস্থিত ছোট্ট অলিন্দ থেকে, যেখানে রাজঅন্তঃপুরের রমণীরা নিজেদের লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে, দরবারের কার্যক্রম দেখতে আর শুনতে পারেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। গুলরুখ আর দিলদারও সম্ভবত সেখানে রয়েছে, শিহরিত শঙ্কায় প্রতীক্ষা করছে তাদের সন্তানের প্রতি সে কি শাস্তির বিধান ঘোষণা করে।