সম্রাট…দয়া করেন…
আরেকটা দুর্বল কণ্ঠস্বর কোথাও থেকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। কণ্ঠস্বরটা নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করছে। সে চোখ খুলে তাকায় এবং নিজের প্রসারিত তারারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে, হুমায়ুন হিংস্র কোনো বাঘের বদলে সালিমাকে দেখতে পায়। সালিমার দেহ, তার নিজের দেহের মতোই ঘামে চুপচুপে হয়ে ভেজা যেন চুড়ান্ত মুহূর্ত নিকটেই উপস্থিত। কিন্তু যদিও সে আসলেই তাঁর মালিক, হুমায়ুনের পেশল হাতের তালু সালিমার পেলব স্তন প্রচণ্ড জোরে আকড়ে রেখেছে যেন সালিমাই সেই হিংস্র জন্তু যাকে পরাভূত করতে সে লড়াই করছিল। সে তার হাতের মুঠি শীথিল করে কিন্তু রমণের বেগ বাড়িয়ে দেয় যতক্ষণ না তারা দুজনেই সুখানুভূতির শীর্ষে পৌঁছে এবং অবসাদে ভেঙে পড়ে।
সালিমা, আমি দুঃখিত। তোমার উপরে এভাবে হামলে পড়া আমার মোটেই উচিত হয়নি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল তোমার জন্য আমার কামনার সাথে প্রভুত্ব স্থাপনের ভাবনাগুলো কেমন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে।
দুঃখিত হবার মতো কিছু হয়নি- আপনার প্রেমিক-সুলভ আচরণ আমাকে ভোগসুখে উদ্বেল করে তোলে। আপনি অন্য এক জগতে ছিলেন আর আমি এখানে যেমন করে থাকি আমি সেখানেও নির্দ্বিধায় আপনার সেবায় রত ছিলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে কষ্ট দেবেন না। এখন এসব ফালতু আলোচনা বাদ দিয়ে আমাকে আরেকবার সঙ্গসুখের তুঙ্গে নিয়ে যান, এইবার একটু কোমলতা আমি আপনার কাছে আশা করতেই পারি।
হুমায়ুন সানন্দে তার প্রত্যাশা পূরণ করে। কামনার ঝড় স্তিমিত হয়ে এলে, সে যখন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে এবং তখনও আফিমের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি, হারেমের পরিচারিকার দল সুগন্ধি মেশান শীতল পানি নিয়ে এসে তার গা মুছিয়ে দেয়। অবশেষে সালিমার বাহুডোরে নিজেকে সপে দিয়ে সে নিন্দ্রাদেবীর বরাভয় লাভ করে। এইবার ঘুমের ভেতর কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে না, হারেমের সেই কক্ষের জাফরি-কাটা জানালা দিয়ে যখন দিনের প্রথম আলোর কোমল আভা তীর্যক ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তখনই কেবল তার সুপ্তির ঘোর কাটে। সে শুয়ে শুয়ে তার মাথার উপরের বেলেপাথরের নক্সা করা ছাদের নীচের অংশে খেলা করতে থাকা আলোক রশ্মির তীব্রতা বৃদ্ধির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার সময়েই সে জানে তাকে কি করতে হবে। বাঘের সাথে তার ইচ্ছা শক্তির লড়াই তাকে সে কথা বলে দিয়েছে। সে হল একজন শাসক। সে অবশ্যই সবসময়ে অমায়িক থাকতে পারে না। কখন কঠোর হতে হবে সেটা জানা থাকলেই কেবল কেউ সম্মান অর্জন করতে পারে।
*
মহামান্য সুলতান। আপনার আদেশ পালিত হয়েছে।
দর্শনার্থী কক্ষ-দরবার হলের মর্মরের বেদীতে স্থাপিত তার সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থা থেকে হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষী দলের প্রধানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তাঁর অমাত্য আর সেনাপতিরা কঠোর অগ্রগণ্যতার বিন্যাস বজায় রেখে তার চারপাশে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করছে। সে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে আদতেই কি ঘটেছে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হবার সামান্য পরেই দেহরক্ষী দলের আধিকারিক তার সাথে নিভৃতে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু সেই সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে দরবারের সবাই বিষয়টা শ্রবণ করেছে এবং আসন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে।
তুমি দারুণভাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। কি ঘটেছিল সেটা দরবারের সামনে খুলে বল।
মহামান্য সম্রাট যেমন আদেশ করেছিলেন, আমি আর বাছাই করা দেহরক্ষীদের একটা ছোট দল সম্রাটের সম্ভাইদের গত রাতে গ্রেফতার করেছি যখন তারা শাহজাদা কামরানের প্রাসাদে পানাহারে মত্ত ছিল।
হুমায়ুন তার চারপাশে সশব্দে একটা শ্বাসটানার আওয়াজ হতে, অতিকষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে। সে সময়টা ভালোই নির্বাচন করেছিল। বাবা ইয়াসভালো তাঁকে সতর্ক করে দেবার পর থেকে পুরো সময়টা নিরাপত্তার খাতিরে সে নিজেকে দূর্গের অভ্যন্তরে অন্তরীণ রেখেছে। তারপরে সপ্তাহখানেক আগের কথা, কাবুলের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, উচ্চণ্ড আর দামী, লাল সুরার একটা চালান গজনী থেকে খচ্চরের কাফিলায় করে এসে পৌঁছে- বাইসানগার, তাঁর নানাজানের কাছ থেকে আগত একটা সময়োচিত উপহার। সুরার প্রতি কামরানের দুর্বলতার কথা জানা থাকার কারণে, হুমায়ুন চালানের একটা অংশ তাঁকে উপহার দেয়। সে যেমনটা আশা করেছিল যে কামরান বাকি ভাইদের তার সাথে পানাহারে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে, তাকে খুব বেশী একটা সময় অপেক্ষা করতে হয় না। হুমায়ুন যথোচিত সৌজন্যের সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে কিন্তু আসকারি আর অল্পবয়সী হিন্দাল, যে এখনও সুরাপান উপভোগ করার মতো বয়সে পৌঁছায়নি, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই যারা সেটা উপভোগ করে তাদের সাহচর্যে থাকতে শ্লাঘাবোধ করে, দ্বিতীয় কিছু না ভেবেই ব্যগ্রতার সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। ষড়যন্ত্রের তিন কুশীলব একসাথে, সর্বোপরি অপ্রস্তুত, নিশ্চায়ক হামলার জন্য উপযুক্ত সুযোগ।
আমার ভাইয়েরা কি প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল?
শাহজাদা কামরান নিজের খঞ্জন বের করেছিলেন আর আমার একজন লোককে তার কানের লতি দ্বিখণ্ডিত করে তাঁকে আহত করেছে, কিন্তু তার এই প্রয়াস ছিল ক্ষণস্থায়ী। অন্যেরা লড়াই করার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি।