হুমায়ুন নিজের ক্রোধকে প্রশমিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, সে সিদ্ধান্ত নেয় রাতটা সে তার প্রিয়তমা রক্ষিতার সাথে কাটাবে- কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোলকার মুখাবয়ব, ধুসর চোখের এক সুনন্যা তরুণী। সালিমা তার রেশমের মতো ত্বক আর কচি ডালিমের মতো স্তনযুগল ব্যবহার করে খুব ভালো করেই জানে কিভাবে তাঁর দেহকে আত্মহারা করে তুলতে হবে এবং পুরো বিষয়টা সে স্পষ্টতই উপভোগ করে। সালিমার প্রণয়স্পর্শ সম্ভবত আজ রাতে তাঁকে মন পরিষ্কার করতে আর তার ভাবনাগুলোকে বিন্যস্ত করতে সাহায্যই করবে এবং তাহলে হয়তো অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা একটু হাল্কা হবে যা সম্ভবত সহসাই আর অলুক্ষণে ভঙ্গিতে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে।
তিন ঘন্টার পরে, হারেমে সালিমার কক্ষে রেশম-আবৃত একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় হুমায়ুন শুয়ে থাকে। তার পেষল শরীর, পোড় খাওয়া পরীক্ষিত একজন যোদ্ধর পক্ষে মানানসই ক্ষতচিহ্নে অলঙ্কত, বাদাম তেলে সিক্ত হয়ে দীপ্তি ছড়ায় মেয়েটা তার ত্বকে চটুল ভঙ্গিতে সেটা মালিশ করেছে যতক্ষণ না এক মুহূর্তও অপেক্ষা করাটা অসহ্য হয়ে উঠে, হুমায়ুন তাকে বুকে টেনে নেয়। সালিমার ধুসর হলুদ বর্ণের মসলিনের স্বচ্ছ আলখাল্লা- হুমায়ুনের সদ্য অধিকৃত ভূখণ্ডের একটা সামগ্রী, যেখানের তাঁতিরা এতো সূক্ষ আর কমনীয় কাপড় বয়ন করে তারা যার নাম রাখে বায়ুর হৃৎস্পন্দন বা ভোরের শিশির- ফুলের নক্সা ভোলা কার্পেটের উপরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সালিমা যদিও তাঁকে পরিতৃপ্ত করেছে এবং তাঁর প্রতি মেয়েটার সাড়া বরাবরের মতোই প্রবল আর হুমায়ুনের উত্তেজনা শিথিল হয়েছে, তার মনে তখনও বাবা ইয়াসভালের ফাঁস করা কথাগুলোই ফিরে ফিরে আসে, তাঁর ক্রোধ আর হতাশাকে পুনরায় জাগরিত করে।
সালিমা, কষ্ট করে আমাকে পান করার জন্য একটু গোলাপজল এনে দেবে।
সে নিমেষের ভিতরেই রূপার পানপাত্র যাতে মূল্যবান পাথর দিয়ে গোলাপের বৃত্তাকার প্যানেল প্রণিহিত করা রয়েছে নিয়ে ফিরে আসে। পাত্রের পানির উটের কাফেলায় করে উত্তরের পাহাড় থেকে অতিকায় চাইয়ের আকৃতিতে কেটে আনা বরফ দিয়ে শীতল করা গন্ধটা মুখরোচক। বিছানার পাশে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স থেকে, হুমায়ুন কয়েকটা আফিমের গুলি বের করে এবং সেগুলো পাত্রের ভিতরে ছেড়ে দেয়, গুলিগুলো পানিতে একটা দুধালো ঘূর্ণি সৃষ্টি করে মিলিয়ে যায়।
পান কর। সে পানপাত্রটা সালিমার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে এবং তাকে ঢোক গিলতে দেখে। তার আনন্দে তাঁকে অংশীদার করাই তার অভিপ্রায়, কিন্তু সে কিছুটা লজ্জিতও বটে তার এমন আচরণের পেছনে আরো একটা অন্য উদ্দেশ্যও রয়েছে। তার আব্বাজান প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন যখন বুয়া- পরাজিত শত্রু সুলতান ইবরাহিম লোদির মা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধ নিতে তাঁকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। সেই সময় থেকে, অন্য কেউ আগে পরীক্ষা করেনি এমন যে কোনো খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে হুমায়ুন সবসময়ে সর্তক থাকে…।
আমার প্রভু, নিন। সালিমা, গোলাপজলে আকর্ষণীয়ভাবে সিক্ত ঠোঁটে, সে তাকে চুমু খায় আর পানপাত্রটা হাতে তুলে দেয়। সে পানপাত্রে গভীর চুমুক দেয়, কামনা করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আফিম যেভাবে তার শোকাবেগ ভোতা করে দিয়েছে আর তার উদ্বেগ হ্রাস করেছে সেভাবে কাজ শুরু করুক, তার মানসপটে আলতো করে কুণ্ডলীমুক্ত হয়ে তাঁকে প্রীতিপ্রদ বিস্মরণের মাঝে নিয়ে যাক।
কিন্তু আজ রাতে সে বোধহয় মাত্রা অতিক্রম করেছে বা এর প্রশমন ক্ষমতার কাছে অনেক বেশী কিছু প্রত্যাশা করছে। সে তাকিয়ায় দেহ এলিয়ে দিতে, তার মনের অলিন্দে অশুভ লক্ষণযুক্ত নানা অবয়বের সৃষ্টি হতে থাকে। তার সামনে দীপ্তিময় নীল গম্বুজ আর সরু মিনারযুক্ত একটা অপূর্বসুন্দর শহর ভেসে উঠে। যদিও সেখানে তার সংক্ষিপ্ত অবস্থান মনে রাখার পক্ষে তাঁর বয়সটা খুবই অল্প ছিল, তবুও সে বুঝতে পারে শহরটা সমরকন্দ, তাঁর মহান পূর্বপুরুষ তৈমূরের রাজধানী আর সেই শহর যা তার বাবা দখল করেছিলেন, হারিয়েছিলেন আর সারাটা জীবন সে জন্য আকুল হয়ে থেকেছেন। বাবরের রেখে যাওয়া প্রাঞ্জল বর্ণনা পড়া থাকার কারণে হুমায়ুন বুঝতে পারে সে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেগিস্তান চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখের সামনে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া তোরণদ্বারের উপরে স্থাপিত গুটিসুটি দিয়ে থাকা কমলা রঙের বাঘটা জীবন্ত হয়ে উঠে, তার কান দুটো মাথার সাথে লেপটে রয়েছে, তীক্ষ্ণ দাঁতের উপরে ঠোঁট টানটান, অবজ্ঞা প্রকাশের জন্য থুতু ফেলতে প্রস্তুত। বাঘটার চোখ দুটো কামরানের চোখের মতো সবুজ।
সহসা, হুমায়ুন নিজেকে বাঘের পিঠের উপরে আবিষ্কার করে, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ওটার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে, টের পায় বাঘটার পেষল শরীর তার নীচে মোচড় খাচ্ছে। সে নিজের উরু দিয়ে তাঁকে শক্ত করে আকড়ে ধরে, প্রাণীটার তপ্ত নিঃশ্বাসের গন্ধ পায় যখন জন্তুটা নিজের দেহ বাকিয়ে, মাথা এপাশ ওপাশ দোলাতে থাকে, তাঁকে ছিটকে ফেলে দেয়ার জন্য বেচারা প্রাণপণ লড়াই করে। হুমায়ুন জটাকে তার দুপা দিয়ে আরও শক্ত করে আটকে ধরে আর টের পায় এর পাঁজর ব্যথায় মোচড়াচ্ছে আর নতুন করে দাপাদাপি শুরু হয়। সে কোনভাবেই ছিটকে যাবে না। সে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে, জটার দেহের নীচে নিজের হাত দুটো পিছলে যেতে দেয়। তার হাতের আঙ্গুলগুলো মাংসপেশী অনুভব করে যা নরম আর মসৃণ এবং তার ভেতরে রয়েছে একটা উষ্ণ, ছন্দোবদ্ধ নাড়ীর স্পন্দন, জটার প্রাণশক্তির উৎস। সে তার মুষ্ঠি শক্ত করার উদ্দেশ্যে চাপ বাড়াতে আর প্রবলভাবে ধাক্কা দিতে থাকলে আচমকা জন্তুটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কর্কশ হয়ে উঠে আর খিচুনী শুরু হয়।