বাবা ইয়াসভালো একটু ইতস্তত করে, তারপরে কক্ষ ত্যাগ না করে সে সরাসরি হুমায়ুনের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে মেঝে থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়। সুলতান, আমার ছেলে, আমার আহাম্মক ছেলেটা…তাকে এবারের মতো মার্জনা করুন…সে সত্যিই নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। সে ভালো করেই জানে এবং আমিও জানি আপনার ক্রোধ স্বাভাবিক আর মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য, কিন্তু আমি আপনার কাছে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা চাইছি, তার প্রতি একটু করুণা প্রদর্শন দেখান…
বাবা ইয়াসভালো। এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করার জন্যই শুধু আপনার অতীত আনুগত্যের কথা স্মরণে রেখে আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ আমি আপনার ছেলেকে কোনো শাস্তি দেব না। তার কর্মকাণ্ডকে অল্প বয়সের অবৈচক্ষণ্য হিসাবে আমি এবারের মতো বিবেচনা করবো। কিন্তু এই ঝামেলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আশা করবো আপনি তাকে নিরাপদ কোনো স্থানে আটকে রাখবেন।
বাবা ইয়াসভালের দেহের ভিতর দিয়ে যেন একটা কম্পনের রেশ বয়ে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য লোকটা কৃতজ্ঞতায় চোখ বন্ধ করে। তারপরে সে উঠে দাঁড়ায় এবং মুণ্ডিত মস্তক নুইয়ে, ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে যায়।
হুমায়ুন, নিঃসঙ্গ হওয়া মাত্র, দ্রুত নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং কারুকার্যখচিত একটা পানপাত্র আকড়ে ধরে রাজকীয় কক্ষের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যায়। নির্বোধের দল! যত্তসব আহাম্মক! তার ভাইয়েরা যদি নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিতে শুরু করে তাহলে অচিরেই মোগলরা মামুলি গোত্রগত যুদ্ধেরত যাযাবর জীবনে ফিরে যাবে এবং তাদের এতো কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত সাম্রাজ্য হাতছাড়া হবে। তাদের আব্বাজানের কাছে তাঁরা যে ঋণী সেই বোধটা তাঁদের কোথায় গেল, কোথায় গেল নিয়তি সম্পর্কে তাদের চেতনা?
মাত্র পাঁচ বছর আগের কথা হুমায়ুন বাবরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে নীচের সমভূমির দিকে ধেয়ে এসেছিল গৌরবের বিজয়তিলক ছিনিয়ে নিতে। যুদ্ধের সেই রক্ত আর গর্জন, তার ঘোড়ার ঘামের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে নাসারন্ধ্র ভরে যাওয়া, সুলতান ইব্রাহিম লোদীর রণহস্তীর বৃংহন, মোগল কামানের হুঙ্কার আর তাদের মাস্কেটের গর্জন যখন এইসব নতুন অস্ত্র কাতারের পর কাতার শত্রু সেনার প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেইসব স্মৃতির কথা মনে পড়তে আজও তাঁর নাড়ীর বেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ সে আজও স্পষ্ট স্মরণ করতে পারে যখন- রক্তরঞ্জিত তরবারি হাতে- পানিপথের ধূলোয় ধুসরিত সমভূমি জরিপ করে সে উপলব্ধি করেছিল হিন্দুস্তান মোগলদের করায়ত্ত হয়েছে। আজ তাঁদের সব অর্জন হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
মধ্য এশিয়ায় আমাদের লোকেরা যখন শাসন করতো তখন তারা যেমন বলতো তখত বা তক্তা সিংহাসন বা শবাধার- আমার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। হুমায়ুন ভাবে, আমরা একটা নতুন দেশে এসেছি এবং অবশ্যই নতুন রীতি গ্রহণ করতে হবে নতুবা আমরা সবকিছু হারাব। সে তার গলায় একটা সুক্ষ সোনার হারের সাথে ঝোলান চাবির খোঁজে তাঁর পরিধানের আলখাল্লার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে, উঠে দাঁড়ায় এবং কক্ষের একপ্রান্তে অবস্থিত গম্বুজাকৃতি বাক্সটার দিকে এগিয়ে যায়। সে বাক্সটার তালা খুলে, ঢাকনিটা পেছনের দিকে সরিয়ে দেয় এবং সে যা খুঁজছিলো সেটা দ্রুত খুঁজে বের করে ফুলের নক্সার একটা রেশমের থলে যেটার মুখ সোনার সুতো দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে বাঁধা। সে খুব ধীরে, প্রায় শ্রদ্ধার সাথে থলের মুখটা খোলে, এবং ভেতরে রক্ষিত সামগ্রী বের করে আনে একটা অতিকায় হীরকখণ্ড যতবারই সে এটা দেখে এর আলোকপ্রবাহী তীব্র ঔজ্জ্বল্যে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। আমার কোহ-ই-নূর, আমার আলোর পর্বত পাথরটার দীপ্তিময় উপরিতলে আলতো করে নিজের আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে সে ফিসফিস করে বলে। পানিপথের যুদ্ধের পরে এক ভারতীয় রাজকুমারী যার পরিবারকে সেই বিশৃঙ্খলার মাঝে রক্ষা করেছিল তাঁকে এটা উপহার হিসাবে দিয়েছিল সে, পাথরটার এমন একটা নিখুঁত সৌন্দর্য আছে যা দেখে তাঁর সবসময়েই মনে হয় ভারতবর্ষে মোগলরা যা খুঁজতে এসেছে- গৌরব আর জাঁকজমকপূর্ণ সমৃদ্ধি যাঁর পাশে পারস্যের শাহকেও ম্লান মনে হবে-তার সবকিছুই এর মাঝে প্রতিভাত হয়ে আছে।
পাথরটা হাতে ধরা অবস্থাতেই, হুমায়ুন চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর চেয়ারের কাছে ফিরে আসে। সে একাকী আর বিষণ্ণ ভঙ্গিতে সেখানেই বসে থাকে যতক্ষণ না। নিচের প্রাঙ্গনে দরবারের সময়রক্ষক ঘড়িয়ালী নিজের প্রহরের তার প্রহরার সমাপ্তি ঘোষণা করতে তাঁর পিতলের চাকতিতে আঘাতের শব্দ ভেসে আসে- তাঁকে মনে করিয়ে দেয় যে রাত শেষ হয়ে এল।
সে অনুধাবন করে যে এটা তাঁর প্রথম গুরুতর পরীক্ষা আর সে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি যাই হোক- এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে সবগুলো সৎ ভাইয়ের গলা পর্যায়ক্রমে টিপে সব কটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়- সে অবশ্যই হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নেবে না, সর্বোপরি এমন কিছু করবে না যার ফলে বোঝা যায় যে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। নিভৃতে দেখা করার জন্য বাবা ইয়াসভালের অনুরোধ কেউ হয়তো খেয়াল করে থাকবে। তার দাদাজান বাইসানগার, বা তার উজির করিম, যে তার মরহুম আব্বাজানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতাদের অন্যতম, যদি এখন কেবল এখানে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু দুই বয়োজ্যেষ্ঠ লোকই বাবরের শবাধার বহনকারী কাফেলার সাথে কাবুলের পথে রয়েছে সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করার বিষয়টা তারা তদারকি করবে। আগামী কয়েক মাসের ভিতরে তাঁদের ফিরে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজত্বের গুরুভার, এর সাথে বিদ্যমান একাকীত্ব সম্পর্কে, তার সাথে একবার তার মরহুম আব্বাজান আলোচনা করেছিল। সে খুব ভালো করেই জানে, তাঁকে নিজেকে এবং একমাত্র তাঁকে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে করণীয় সম্বন্ধে কিন্তু তার আগে তাঁকে অবশ্যই তার মনোভাব গোপন রাখতে হবে।