আমার কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে তুমি ভালোই করেছে। আমাকে সবকিছু বলো।
মহামান্য সুলতান, আপনার মরহুম আব্বাজানের শবাধার কাবুলের পথে রওয়ানা হওয়ার বড়জোর এক পক্ষকাল পরেই, যুবরাজ কামরান, আসকারি আর হিন্দাল এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দুদিন লাগে এমন দূরত্বে অবস্থিত একটা দূর্গে মিলিত হয়। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে আমার ছেলে কামরানের অনুগত, সে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়ার জন্য তাঁকে প্রচুর পারিতোষিকের লোভ দেখায়। মাথা-গরম অল্পবয়সী নির্বোধ যা সে আসলেও, সে তাদের সাথে যোগ দিতে সম্মত হয়, আর তাই সবকিছু দেখে আর শোনে।
আমার ভাইয়েরা কি পরিকল্পনা করছে?
আপনাকে বন্দি করবে আর তারপরে আপনাকে বাধ্য করবে সাম্রাজ্য ভাগ করতে আর তাঁদের কাছে আপনার কিছু এলাকা সমর্পন করতে। সুলতান তারা সনাতন প্রথায় ফিরে যেতে চায়, যখন প্রত্যেক সন্তানই তাদের বাবার ভূখণ্ডের একটা অংশের অধিকার লাভ করতো।
একটা নিষ্প্রাণ হাসি হুমায়ুনের চেহারায় ভেসে উঠে। আর তারপরে কি হবে? তারা কি এতেই সন্তুষ্ট থাকবে? অবশ্যই না। তারা অচিরেই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে আর সেই সুযোগে শত্রুরা আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে।
সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা এমনকি এখনই নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারছে না। কামরান হল আসল উস্কানিদাতা। পুরো ষড়যন্ত্রটাই তার মস্তিষ্কপ্রসুত আর তার সাথে যোগ দিতে সেই সবাইকে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু তারপরেই আসকারি আর তার ভিতরে রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়েছে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলো তাদের ভিতরে কে নেবে সেটা নিয়ে। তাদের অনুগত লোকেরা কোনোমতে তাঁদের হাতাহাতি থেকে বিরত করেছে।
হুমায়ুন কোনো কথা না বলে পুনরায় বসে পড়ে। বাবা ইয়াসভালের কথা তার কাছে সত্যিই মনে হয়। তার চেয়ে কেবল পাঁচ মাসের ছোট, তার সৎ-ভাই কামরানকে যখন কাবুল শাসনের জন্য সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে আসা হয় তখন সে নিজের অসন্তোষ গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি। হিন্দুস্তানের অভিযানে হুমায়ুন তাদের আব্বাজানের সঙ্গী হয়। কামরানের আপন ভাই, পনের বছরের আসকারিকে, তাঁদের সাথে যোগ দেবার জন্য খুব বেশী একটা কষ্ট করতে হয়নি। কামরান যেখানে যেত সেখানেই একনিষ্ঠ ভক্তের মতো সে সবসময়ে তাঁকে অনুসরণ করতে যদিও কামরান তাকে কখনও দূর্বল পেয়ে নিপীড়ন করতো আবার কখনওবা তাঁকে প্রশ্রয় দিত। কিন্তু বাবা ইয়াসভালের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, এখন তাহলে আসকারি প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠেছে বড় ভাইকে দ্বৈরথে আহ্বান জানাতে সে মোটেই ভীত নয়। সম্ভবত তাঁদের দুজনকেই তাদের কঠোর মনোভাবসম্পন্ন মা গুলরুখ উসকে দিয়েছে।
কিন্তু তাঁর সৎ-ভাইদের ভিতরে কনিষ্ঠতমের এসবের সাথে কি সম্পর্ক? হিন্দাল কেন এসবের ভিতরে নিজেকে জড়াতে গেল? তার এখন মাত্র বার বছর বয়স আর হুমায়ুনের আপন মা, মাহামের স্নেহ ছায়ায় সে বড় হয়েছে। বহু বছর আগে হুমায়ুনের পরে আর কোনো সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজের অপারগতায় বিপর্যস্ত মাহাম বাবরের কাছে মিনতি করে তার অন্য স্ত্রী, দিলদারের সন্তানকে চেয়ে নেয়। হিন্দাল যদিও তখনও মাতৃগর্ভে, বাবর- তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর অনুরোধ ফেলতে পারে না- সদ্যোজাত সন্তান তাঁকে উপহার দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু হিন্দালের এই প্রতারণায় সে অবশ্য খুব একটা অবাক হয় না। বাবরের নিজের যখন মাত্র বার বছর বয়স তখন প্রথম তিনি রাজা হন। উচ্চাকাঙ্খার আগুন এমনকি কনিষ্ঠতম যুবরাজের ভিতরেও জ্বলে উঠতে পারে।
সুলতান, বাবা ইয়াসভালের ব্যগ্র, আন্তরিক কণ্ঠস্বর হুমায়ুনকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার ছেলের বিশ্বাস যুবরাজরা নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারেনি বলেই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। কিন্তু গতরাতে এখানে এই আগ্রা দূর্গে, তারা পুনরায় মিলিত হয়। আপনাকে তাদের কজায় না আনা পর্যন্ত তারা নিজেদের ভিতরের মতপার্থক্য ভুলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা তাদের ভাষায় আপনার নির্জনতার জন্য সম্রাটের পক্ষে বেমানান আকাঙ্খার সুযোগ নেবে বলে ফন্দি এঁটেছে এবং পরেরবার আপনি যখন ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হবেন তখনই তারা আপনাকে আক্রমণ করবে। কামরান আপনাকে এমনকি হত্যা করার কথাও বলেছে এবং পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা দূর্ঘটনার মতো দেখায়। আমার ছেলের তখন বোধোদয় ঘটে। মহামান্য সুলতান আপনার আসন্ন বিপদের কথা অনুধাবন করতে পেরে, সে আমাকে সবকিছু খুলে বলে যা কয়েক সপ্তাহ আগেই তার কবুল করা উচিত ছিল।
বাবা ইয়াসভালো, এভাবে সরাসরি আমার কাছে আসার কারণে, আপনার সাহসিকতা আর আনুগত্যের জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি ঠিকই বলেছেন। পুরো ব্যাপারটার ব্যাপ্তি ভয়ঙ্কর বিশেষ করে যখন আমার সৎ-ভাইয়েরা আমারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আর তারচেয়েও বড় কথা আমাদের আব্বাজানের ইন্তেকালের পরে এতো শীঘই। আপনি কি এ বিষয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করেছেন?
না, সুলতান।
ভালো করেছেন। বিষয়টা নিয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করা থেকে আপনি আপাতত বিরত থাকবেন। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দেন। কর্তব্য করণীয় নিয়ে আমি একটু ভাবতে চাই।