এবার চল। এসব চিন্তাভাবনা অনেক হয়েছে। হারেমে চাদর বিছানো হয়ে গিয়েছে। তোমার আম্মিজান আর অন্যান্য মহিলাদের তুমি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করিয়ে রাখবে না। কিন্তু হুমায়ুন…একটা শেষ অভিপ্রায়। ভুলে যেও না যে তোমার নামের মানে ভাগ্যবান। সৌভাগ্য তোমার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়বে যদি শারীরিক আর মানসিকভাবে তুমি শক্তিশালী হও আর সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। নিজের প্রতি তোমার এসব অর্থহীন সন্দেহ পরিত্যাগ কর। অন্তবীক্ষণ একজন কবি বা সুফিসাধকের জীবনে হয়ত গুরুত্ব বহন করতে পারে কিন্তু একজন ম্রাটের জীবনে এর কোনো স্থান নেই। তোমার আব্বাজান- আর নিয়তি তোমাকে যা দান করেছে দুহাতে সেটা গ্রহণ কর।
শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখে চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, হুমায়ুন ধীর পায়ে তার খালাজানকে অনুসরণ করে পাথরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যেটা জেনানা মহলের দিকে নেমে গিয়েছে।
*
কয়েক সপ্তাহ পরের কথা- সম্রাটের ব্যক্তিগত কামরায় হুমায়ুনের সামনে তাঁর অশ্বশালার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সচরাচর উফুল্ল, আর কিঞ্চিৎ স্কুলবুদ্ধির বাবা ইয়াসভালো নিজেকে ভূম্যবলুণ্ঠিত করে, কোনো বিচিত্র কারণে সে সন্ত্রস্ত। লোকটা আনত অবস্থা থেকে পুনরায় যখন উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়, হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে লোকটার চোখের নিম্নাংশের চওড়া হাড়ের উপরে তার ত্বক যেন অস্বাভাবিকভাবে টানটান হয়ে প্রসারিত হয়ে রয়েছে এবং তার কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে।
সুলতান, আমাকে একাকী যদি আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি দিতেন? বাবা ইয়াসভালো রৌপ্য নির্মিত হুমায়ুনের নীচু বসবার আসনের দুপাশে দণ্ডায়মান প্রহরীদের দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। একটা অস্বাভাবিক অনুরোধ। নিরাপত্তার খাতিরে সম্রাট কদাচিৎ একাকী অবস্থান করেন। এমনকি তিনি যখন হারেমে অবস্থান করেন তখনও ঘাতকের তরবারির আঘাত নাকচ করতে সতর্ক প্রহরীর দল সবসময়ে তার আশেপাশেই অবস্থান করে। কিন্তু বাবা ইয়াসভালো, যে হুমায়ুনের মৃত আব্বাজানের অধীনে বিশ্বস্ততার সাথে যুদ্ধ করেছে, তাকে বিশ্বাস করা যায়।
হুমায়ুন প্রহরীদের কামরা ত্যাগ করতে আদেশ দেয় আর ইঙ্গিতে বাবা ইয়াসভালোকে কাছে আসতে বলে। লোকটা সামনে এগিয়ে আসে বটে কিন্তু কথা বলতে ইতস্তত করে, সে তার মাথার খোঁচা খোঁচা চুল চুলকায়, যা তাঁকে তাঁর গোত্রের সনাতন পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, হিন্দুস্তানে আসবার পরে সে মাথা কামান শুরু করলেও, ধুসর রুক্ষ চুলের একটা গোছা সে রেখে দিয়েছে যা একটা টাসেলের মতো দোল খায়।
বাবা ইয়াসভালো, বলল। তুমি আমাকে কি বলতে চাও?
খারাপ খবর…সুলতান, ভয়াবহ খবর… বাবা ইয়াসভালের মুখ দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয়। আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র দানা বেধেছে।
ষড়যন্ত্র? সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুনের হাত তার হলুদ পরিকরের ভাঁজে গোঁজা রত্নখচিত দুধারি খঞ্জর স্পর্শ করে এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। কার এতো বড় দুঃসাহস…?
বাবা ইয়াসভালো নিজের মাথা নত করে। সুলতান, আপনার সৎ-ভাইয়েরা।
আমার ভাইয়েরা…? মাত্র দুমাস আগে সে আর তার ভাইয়েরা আগ্রা দূর্গের প্রাঙ্গণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যখন বারোটা কালো ষাড় জোতা গিল্টি করা গাড়িটা তাঁদের মরহুম আব্বাজানের রূপার শবাধার নিয়ে কাবুলের পথে দীর্ঘ যাত্রায় রওয়ানা হয়, বাবর সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করার অনুরোধ করেছিলেন। তার নিজের মতো তার সৎ-ভাইদের চোখে মুখেও শোকের একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটেছিল এবং সেই শোকাবহ মুহূর্তগুলোতে তাঁদের প্রতি স্নেহ আর মমত্ববোধের একটা আকষ্মিক বেগ তাঁকে আপুত করে তুলে এবং আস্থার জন্ম দেয় যে তাঁদের মরহুম আব্বাজানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে তাঁরা তাঁকে সাহায্য করবে: হিন্দুস্তানে মোগলদের আধিপত্যকে অনাক্রম্য করতে।
বাবা ইয়াসভালো হুমায়ুনের চোখে মুখে অবিশ্বাস আর সংক্ষোভ ঠিকই পড়তে পারে। সুলতান, আমি সত্যি কথাই বলছি, যদিও আমাদের সবার স্বার্থে আমাকে এটা বলতে না হলেই আমি খুশী হতাম… বাবা ইয়াসভালো এখন যখন বলতে শুরু করেছে, সে সাহস সঞ্চয় করছে বলে মনে হয়, পুনরায় পানিপথে মোগলদের হয়ে লড়াই করা সেই পোড় খাওয়া যোদ্ধার সত্তা তার ভিতরে ফিরে আসতে থাকে। তার মাথা এখন আর নত না এবং সে হুমায়ুনের চোখের দিকে নিঃশঙ্কভাবে তাকিয়ে রয়। আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন না যখন আমি আপনাকে বলবো যে আমি এই তথ্য আমার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানতে পেরেছি…সে ষড়যন্ত্রকারীদেরই একজন। সে মাত্র ঘন্টাখানেক আগে আমার কাছে এসে সবকিছু স্বীকার করেছে।
সে এটা কেন করেছে? হুমায়ুনের চোখ সরু হয়ে আসে।
কারণ নিজের জীবনের জন্য সে ভীত…কারণ সে বুঝতে পেরেছে সে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে…কারণ সে জানে তার কর্মকাণ্ড আমাদের গোত্রের জন্য কেবল অসম্মান আর ধ্বংসই ডেকে আনবে। এই শেষের শব্দগুলো যখন সে বলছে, বাবা ইয়াসভালোকে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ পরিশ্রম করতে হয় বলে তাঁর চোখমুখ কুচকে যায়।