‘সাহসিকতায় আপনার সমকক্ষ হওয়া খুব কঠিন, কিন্তু কথা দিচ্ছি আমার বাবার ইচ্ছা বা আমাদের বংশের কোনো অমর্যাদা আমি হতে দেব না।’
‘তাহলে কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো? তুমি বয়সে নবীন, উচ্চাকাঙ্খী… তোমার বাবা অসুস্থ হবার বহু পূর্বেই মসনদের প্রতি আগ্রহী ছিলে তুমি; সে আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিল।’
‘তাঁর মৃত্যু যখন হয় তখন বিষয়টা খুবই আকষ্মিক ছিল। আমি অনেক কথাই তাকে বলতে পারিনি। সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আমি এখনও নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে করি না…নিদেন পক্ষে এত দ্রুত বা এভাবে নয়।’
হুমায়ুন তাঁর মাথা ঝুঁকে পড়তে দেয়। কথাটা সত্যি। তাঁর বাবার অন্তিম মুহূর্তগুলো তাঁকে এখনও তাড়িয়ে নিয়ে ফিরে। বাবর নিজের শেষবিন্দু শক্তি একত্রিত করে, তার ব্যক্তিগত পরিচারকদের আদেশ দিয়েছিলেন রাজকীয় আলখাল্লায় সজ্জিত করে তার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে তাঁকে এবং তাঁর অমাত্যদের তাঁর সামনে হাজির হতে। পরিপূর্ণ রাজদরবারের সামনে, দূর্বল কণ্ঠে কিন্তু নিজের সংকল্পে অবিচল, বাবর তার আঙ্গুল থেকে ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের মস্তক খোদিত তৈমূরের ভারী সোনার অঙ্গুরীয় খুলে নেয়ার জন্য হৃমায়ুনকে আদেশ দেন এবং বলেন, এটা গর্বের সাথে ধারণ করবে এবং এটা তোমার উপরে যে দায়িত্ব অর্পন করছে সেটা কখনও বিস্মৃত হবে না…’ কিন্তু বাবরের তখন মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়স, তখনও নিজের শ্রেষ্ঠ সময়ের তুঙ্গে এবং নিজের বিকাশমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব আরেকজনের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বড্ড অল্প বয়স।
‘কোনো মানুষ, এমনকি একজন সম্রাটের পক্ষেও জানা সম্ভব না কখন আর কিভাবে তার কাছে বেহেশতের ডাক এসে পৌঁছাবে। আমাদের কারো পক্ষেই নিজেদের জীবনের গতিপথ পুরোপুরি অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। নশ্বরতার চরম অনিশ্চয়তা আর সেই সাথে ভাগ্যের নানা উত্থানপতন মেনে নিয়ে বাঁচতে শেখাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বেড়ে উঠার অংশ।’
‘মানছি। কিন্তু আমি প্রায়শই চিন্তা করি আমাদের জীবনের অন্তরালে মূলগত নকশা অনুধাবনে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। ঘটনা পরম্পরা যা আপাত দৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হয় হয়ত তেমনটা নয়। খালাজান, আপনি এইমাত্র যেমন বললেন যে আমার আব্বাজানের মৃত্যু ছিল পরম করুণাময়ের কাম্য, কিন্তু আপনি ভুল করেছেন। সেটা ছিল আদতে আমার আব্বাজানেরই অভিপ্রায়। আমার জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’
খানজাদা চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তুমি কি বলতে চাইছো?
আমাকে বলা আব্বাজানের শেষ কথাগুলো কখনও কারো কাছে প্রকাশ করিনি আমি। তিনি মারা যাবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ফিসফিস করে বলেছিলেন যে কয়েক মাস পূর্বে আমি যখন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম, আমার জ্যোতিষী শারাফ তাঁকে বলেছিল সে গ্রহ নক্ষত্র বিবেচনা করে জেনেছে আব্বাজান যদি আমাকে জীবিত দেখতে চান তাহলে তাঁর কাছে যা সবচেয়ে মূল্যবান সেটা অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে তাকে। আর তাই সেজদায় নতজানু হয়ে আমার জন্য আল্লাহর কাছে নিজের জীবন অর্পণ করেছিলেন।
তাহলে এটা বাস্তবিকই আল্লাহর অভিপ্রায়-পরম করুণাময় তার ত্যাগস্বীকার গ্রহণ করেছেন।
না! শারাফ আমাকে বলেছে, সে আসলে বলতে চেয়েছিল যে আমার আব্বাজানের উচিত কোহ-ই-নূর হীরকখণ্ডটা নিবেদন করা তাঁর নিজের জীবন নয়। কিন্তু আমার আব্বাজান তার কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল…এটা আপাতদৃষ্টিতে আপুতকর যে আমার আব্বাজান আমাকে এতো ভালোবাসতেন, আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য আমাকে এতো গুরুত্বের চোখে দেখতেন যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমার প্রতি এতোটা বিশ্বাসের যোগ্য আমি কিভাবে হয়ে উঠব? আমার মনে হয় একদা যে মসনদের জন্য এত উদগ্রীব ছিলাম আমি বোধহয় তার উপযুক্ত নই। আমার ভয় হয় যে এভাবে সূচিত হওয়া রাজত্বকালের ললাটে কলঙ্কের তিলক জুটবে…
এসব ভাবনা অবান্তর। কার্য আর কারণের পেছনের ছক খুঁজতে তুমি বড্ড পরিশ্রম করছে। অনিশ্চয়তা আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে অনেক রাজত্বেরই সূচনা হয়েছে। তোমার রাজত্বের সমাপ্তি সেরকম হবে না সেটা তোমার নিজের কর্মোদ্যোগের দ্বারা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তোমার উপরেই বর্তায়। বাবর কোনো ত্যাগস্বীকার করে থাকলে তোমার জন্য তাঁর ভালোবাসা আর তোমার প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকেই সেটা করেছে। এটাও মনে রেখো সে কিন্তু সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করেনি- তুমি সুস্থ হয়ে উঠার পরেও সে আরো আট মাস সময় জীবিত ছিল। সেই সময়ে তাঁর মৃত্যু হলে সেটা একটা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার হত। খানজাদা দম ফিরে পেতে কথার মাঝে একটু বিরতি দেয়। সে কি তার শেষ সময়ে তোমাকে অন্য আর কিছু বলেছিল?
তিনি আমাকে দুঃখ করতে নিষেধ করেছিলেন…চলে যেতে হচ্ছে বলে তাঁর মন মোটেই ভারাক্রান্ত ছিল না। তিনি অবশ্য আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন- আমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কিছু না করতে, যতই সেটা তাদের প্রাপ্য হয়ে থাকুক।
খানজাদার মুখে বিদ্রূপ খেলা করে। হুমায়ুন এক মুহূর্তের জন্য ভাবে তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে সে বোধহয় কোনো মন্তব্য করবে, কিন্তু সেটা না করে, সে নিজের ছোট কিন্তু অভিজাত মাথাটা কেবল আন্দোলিত করে, আপাতদৃষ্টিতে সে কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয় মনে করেছে।