কিন্তু আমার স্বামীতো প্রতিদিন পুরানা কিল্লার বেলকনি থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন। আমরা কী বলব লোকজন যখন তাঁকে আর দেখবে না?
আমরা এমন কাউকে নেবো যার উচ্চতা তাঁর মতো এবং তাঁকে রাজকীয় পোষাকে সাজাব। নদীর ওপার থেকে কেউই তাঁকে চিহ্নিত করতে পারবে না।
আকবর কী করবে পরবর্তী দিনগুলোতে?
তিনি হেরামের ভেতরে থাকবেন। আমি উনার জন্য অতিরিক্ত রক্ষী বাহিনী মজুত করার চেষ্টা করব- যারা আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক। আপনার কক্ষের চারপাশেও তারা থাকবে। তার প্রত্যেকটি খাবার, পানীয় সব কিছুই প্রথমে পরখ করে তারপর তাঁর কাছে পাঠানো হবে।
আপনি কি পরিস্থিতিতে ভয়াবহ বলে মনে করছেন?
হ্যাঁ, মহারানী, কোনো সন্দেহ নেই। মনে করেন কীভাবে ইসলাম শাহের বড় পূত্রকে এই দিল্লিতেই হত্যা করা হয়। মাত্র তিন বছর আগে গোপনে মায়ের সামনে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
এবার আপনি যা বলবেন আমরা ঠিক তাই করব। এটাই আমার স্বামী চেয়েছেন।
*
সেই রাতে জ্যোৎস্না ও নক্ষত্র ভরা ছিল আকাশ। পুরানা কিল্লার দেয়ার ভেতরে একটি ছোট বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন আকবর। মাত্র তিন মাস আগে বাগানটি করেছিলেন হুমায়ূন। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বৈরম খান, জওহর ও আরো কয়েকজন বিশ্বস্থ রাজকর্মচারী। মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে সমাধিস্ত করার এই দৃশ্যটি শুধু তারাই দেখতে পারবেন। কোনো নারী সেখানে আসেননি। এমনটি খুব নিকটের যারা তারাও না। হামিদা আর গোলবদন উপর থেকে দেখছেন। সুগন্ধি জলে ধুয়া হয়েছে হুমায়ূনের শরীর। নরম একটি কাপড় দিয়ে মোড়ে দেয়া হয়েছে। তারপর কাঠের একটি বাক্সে রেখে বাগানের মাটিতে কবর দেয়া হয়েছে। একজন মোল্লা জানাজা পড়ালেন এবং হুমায়ূনের মাগফিরাত কামনা করলেন।
আকবর যখন ভাবলেন যে তিনি তাঁর পিতাকে আর দেখতে পারবেন না তখন তাঁর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো। তাঁর মনে উৎকণ্ঠাও ছেয়ে গেল। কয়েক দিন আগে তাঁর জীবন ছিল কতো সুখের ও নিরাপদ। কিন্তু এখন সব কিছুই বদলে গেছে। তাঁর চারিদিকে উদ্বেগ লক্ষ্য করছিলেন। যদিও তার মা ও বৈরাম খান খুব সামন্যই বলেছেন, তিনি তাঁদের মুখভঙ্গি ও কথা শুনে তাঁদের উদ্বেগ লক্ষ্য করেছেন। তবে তাঁদের এই উদ্বেগ তার জন্য নয়।
কিন্তু তিনি ভীত হলে চলবে না। তাঁর রক্ত তৈমুরের। অতীতে রয়েছেন তাঁর দাদা বাবর, তিনি এক নির্দয় সুযোগের কারণে তাঁর নিজের অধিকারের জিনিস হাতছাড়া করতে পারেন না। চোখ বন্ধ করে, আকবর নীরবে তাঁর মৃত পিতার কথা স্মরণ করতে লাগলেন। আমি আপনার কাছে অঙ্গিকার করছি যে আপনি এই সাধারণ সমাধিতে বেশি দিন শায়িত থাকবেন না, সর্বসাধারণের দৃষ্টির বাইরে। যেইমাত্র আমি দিল্লিতে এবং সামর্থ্যবান, আমি আপনার জন্য বিশ্ব যা এখনও দেখেনি সে রকম চমৎকার সমাধিসৌধ বানাবো। আমি নতুন মোগল সম্রাট আকবর হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে এই শপথ নিলাম… আমার শ্রদ্ধাভাজন পিতা, আপনি আমাকে শ্রেষ্ঠ (গ্রেট) উপাধি দিয়েছেন এবং আমি শ্রেষ্ঠই হবো। শুধুমাত্র আপনার স্মৃতিতেই নয়, আমার ভাগ্য নির্মাণের যে স্বপ্ন তাঁর কাছেও শ্ৰেষ্ঠ হবো আমি।
.
ঐতিহাসিক নোট
আমি সৌভাগ্যবান যে দ্বিতীয় মোগল সম্রাট ও যোদ্ধা হুমায়ূনের গল্প যথেষ্ঠ তথ্যসমৃদ্ধ ছিল। তাঁর বাবা বাবরকে নিয়ে লেখা আমার আগের বই রাইডার্স ফ্রম দ্য নর্থ থেকে এটি বেশি সমৃদ্ধ। রোমাঞ্চকর যাত্রা, ট্রাজিডি, দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন বিজয় হুমায়ুন ও তার সৎবোন গুলবদনের জীবনকে জড়িয়ে আছে। মোগল সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী হুমায়ূননামায় গোলাপদেহী রাজকুমারির প্রতি স্নেহের বৃত্তান্ত রয়েছে। হুমায়ূনের সভাসদ জওহর তাদকিরাত আল-ওয়াকিয়াত নামে তাঁর একটি জীবনী গ্রস্থ প্রণয়ন করেছিলেন। এছাড়া হুমায়ূন পুত্র আকবরের বন্ধু ও উপদেষ্টা আবুল ফজল আকবরনামা হুমায়ুনের শাসনামলের বিভিন্ন বৃত্তান্ত উল্লেখ করেন।
সুন্দর বর্ণনায়, অতিশয়োক্তির ফুলঝরিতে হুমায়ূনকে বীর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আধ্যাত্বিক মহিমায় উজ্জল এবং কখনো কিছুটা খামখেয়ালি ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন বিভিন্ন বিষয় আকাশে নক্ষত্রে লেখা থাকে এবং পৃথিবীর শুরুতে সবকিছু চারটি মৌলিক জিনিস- বাতাস, পানি, মাটি ও আগুন ধারা নিয়ন্ত্রিত হতো। নির্দিষ্ট দিনে তিনি নির্দিষ্ট রঙের পোষাক পরতেন, মঙ্গলবার দুষ্কৃতিকারী কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করতেন। এই দিনটিতে প্রতিহিংসা ও ক্রোধের দিন হিসেবে দেখতেন তিনি। ওইদিন তিনি রাজকীয় লাল পোষাক পরতেন এবং মহাকাশে নক্ষত্রের গতিবিধি দেখার জন্য সভাসদদের নির্দেশ দিতেন। তাঁর প্রথম জীবনে আফিম সেবনের অভিজ্ঞতা ছিল যা তাকে পরবর্তীতে সতর্ক, গতিশীল ও আধ্যাত্বিক চিন্তা গ্রহণে সাহায্য করেছে।
মুল সামরিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলার ঘোড়াব্যবসায়ী উচ্চাভিলাসী পুত্র শেরশাহ হুমায়ূনকে হিন্দুস্তানের বাইরে পাঠান। শেরশাহের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের পর হুমায়ূনকে রক্ষা করেন তরুণ নিজাম। তিনি নিজামকে সিংহাসনে বসার অনুমতি দেন। হামিদাকে নিয়ে রাজস্তানের মরুভূমিতে হুমায়ূনের যুদ্ধ, নির্জন উমরকতে আকবরের জন্ম, পারস্যে আশ্রয়ের জন্য যাত্রা করেন- এসব সত্য। তবে হুমায়ুনের খুশি হওয়ার মতো বিষয় হলো তিনি শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্তানে হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পান। হিন্দুস্তানের সিংহাসন লাভের মাত্র ছয় মাস পর তিনি মহাকাশ পর্যবেক্ষকের ছাদ থেকে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে মারা যান। সেখানে তিনি আকাশের প্রিয় নক্ষত্রদের পর্যবেক্ষণ করতেন। এতে তাঁর বিধবা স্ত্রী হামিদা ও তরুণ আকবর হিন্দুস্তানের সাম্রাজ্য বাঁচানোয় জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন।