আমি চেষ্টা করব, তবে তাঁর জীবন আল্লাহর হাতে।
কাঁধ থেকে নামানো থলেটি খুলে ঔষদি লতার একটি তুড়া বের করলেন। এর তিক্ত গন্ধ চারদিক ছেয়ে গেল। আগুন জালানোর ব্যবস্থা করুন তিনি উপস্থিত রাজ কর্মচারিদের নির্দেশ দিলেন। এই লতাগুল্মগুলো গরম পানিতে সিদ্ধ করা দরকার যাতে এগুলোর রস পানিতে বের হয়। হুমায়ুনের শয্যার পাশেই কয়লা দিয়ে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাকিম একটি বড় পানি রাখার পাত্র জোগাড় করলেন। লতাগুল্মগুলো সেই পানির পাত্রে রাখলেন। এটা করার পর, তিনি চিকিৎসার জন্য একটি ছোট ধারালো চাকু বের করলেন। আমি চাচ্ছি তাঁর শরীর থেকে রক্তক্ষরণ ঘটাতে, এতে তার মস্তিস্কের ওপর চাপ কমে যাবে এবং আমি মনে করি আঘাত সেরে উঠবে। কাউকে এই কাপটি ধরতে হবে।
আমি ধরব আকবর তাৎক্ষণিক বললেন। বিছানার কাপড়ের নিচ দিয়ে হুমায়ূনের ডান বাহু ধরলেন হাকিম। তিনি কাছে টেনে চাকু হাতে নিলেন। তিনি ধারালো চাকু দিয়ে কনুইয়ে একটু কেটে দিলেন তিনি। যখন রক্ত পড়া শুরু হলো একটি গোলাকার পাত্র দিয়ে সেই রক্ত জমা করতে লাগলেন আকবর। লাল রক্ত দেখে আশা জেগে উঠল হাকিমের মনে। এটা প্রমাণিত যে তার শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো এখনও সচল রয়েছে। তাঁর পিতা অনেক শক্তিশালী, তিনি ভাবলেন। ইতোমধ্যে কিছুটা জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন তিনি। নিশ্চিতভাবে তিনি এই সংকট উৎরে যাবেন…
কিছুক্ষণ পর হাকিম বোলটি সরিয়ে নিতে আকবরকে বললেন। যে স্থানটি কাটা হয়েছে সেখানে একটি সাদা সুতি কাপড়ের টুকরো লাগিয়ে দিতেও বললেন। হুমায়ূন বিড়বিড় করে কিছু বলতে শুরু করলেন। আকবর তার ঠোঁটের কাছে নিজের মাথা ঝুঁকালেন। তিনি কী বলছেন তা বুঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। আমি এখানে পিতা, আমি এখানে। তিনি বললেন। তার প্রত্যাশা হুমায়ূন হয়তো তার কথা শুনতে ও বুঝতে পারবেন। হঠাৎ তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং হুমায়ুনকে জড়িয়ে ধরলেন।
যুবরাজ আমাদের উচিৎ চিকিৎসার জন্য হাকিমকে ছেড়ে দেয়া নম্রভাবে আকবরের কাঁধে ধরে বললেন বৈরাম খান।
আপনি ঠিক বলেছেন। পিতার মুখের দিকে শেষবারের মতো এক পলক তাকিয়ে আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং অসুস্থ হুমায়ূনের চিকিৎসা কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন। যখন দরজা পেছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল, তিনি দেখতে পারলেন না হাকিম ধীরলয়ে বৈরাম খান ও জওহরের দিকে মাথা নেড়েছেন।
*
মহারানী, এতো দ্রুত মহারাজের মৃত্যুতে আমরাও মর্মাহত। তবে আমার বিশেষ কোনো পছন্দ নেই। যদি আপনি আপনার সন্তানের জীবন প্রত্যাশা করেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই আমার কথা শুনা প্রয়োজন…
হামিদা তাঁর ফ্যাকাশে, রঞ্জিত মুখ তুলে বৈরম খানের দিকে তাকালেন। তার চোখ দুটি কান্নায় লাল হয়ে আছে। মুখের নিচের অংশ হাত দিয়ে মুছলেন। কিন্তু আকবর বিপদে পড়তে পারেন বলে যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা হামিদাকে কিছুটা বিব্রত করল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল যথেষ্ঠ ভারি। তিনি বললেন, তুমি কি বলতে চাচ্ছ বৈরাম খান?
হিন্দুস্তানে ক্ষমতায় আসার পর আল্লাহ আপনার স্বামীকে বেহেস্ত তুলে নিয়েছেন। যদিও বিতর্কহীনভাবে আকবর সিংহাসনের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী, কিন্তু রাজপুত্রের বয়স মাত্র ১৩ বছর। যদি আমরা সতর্ক না হই, উচ্চাকাঙ্খি লোকজন তাঁর কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নিতে চাইবে। কামরান ও আসকারির সমর্থকরা বছরের পর বছর ধরে আপনার স্বামীর প্রতি অনুগত। তারপরও তারা এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিতে পারে, যদিও আসকারি মারা গেছেন এবং কামরান অন্ধ ও মক্কায় রয়েছেন। আমরা আমাদের অনুগত রাজ্যের শাসকদের কথাও ভাবতে পারি। উদাহরণসরূপ মুলতানের সুলতান ধূর্ত আজাদ বেগের কথাই ধরুণ। আমরা হিন্দুস্তান জয়ের পর তিনি কেবল আনুগত্য দেখিয়েছেন। হয়তো আবার এই আনুগত্য প্রত্যাহার করতে পারেন। আর এই খবরটি হয়তো বাংলার জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সিকন্দর শাহকেও উৎসাহ যোগাতে পারে। তিনি আবারও শক্তি সামথ্য নিয়ে হামলা চালাতে আসবেন। এছাড়া গুজরাটের সুলতানের মতো আমাদের বহিঃশত্রুও রয়েছে…
বৈরাম খান, যথেষ্ট হয়েছে, হামিদা তাঁকে থামিয়ে দিলেন। আমার স্বামী আপনাকে পছন্দ করেছেন খান ই জাহান হিসেবে, কারণ তিনি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আমিও আপনাকে বিশ্বাস করি- এবার বলুন আমাদের কী করা উচিৎ।
যেসব রাজ্য আমাদের প্রতি অনুগত থাকবে তাদের জড়ো করার জন্য আমরা কয়েক দিন মহারাজের মৃত্যুর খবর গোপন রাখব। এরমধ্যে আগ্রার আহমেদ খানের মতো লোকদের কাছে জানতে চাইবো। যখন আমাদের বিশ্বস্থ সমর্থকরা এখানে আসবেন তাঁদের লোকজন নিয়ে তখন আমরা রাজপূত্রের নামে মসজিদে কোনো ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে খুতবা পড়ব। আমি মনে করি জাহিদ বেগ খুব বেশি দূরে নন। আমি মহারাজের মৃত্যুতে তাঁকে আনতে পাঠিয়েছি। আমরা তাঁকে কাবুল ও খাইবার পথের বিভিন্ন অঞ্চল নিরাপদ রাখতে বলব।
কিন্তু আমার স্বামীর মৃত্যুকে কিভাবে আমরা গোপন রাখব?
দ্রুততা ও বিবেচনার মাধ্যমে কাজ করে। পুরানা কিল্লা ও শহরের বাইরের লোজন জানে যে মহারাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। বর্তমানে মাত্র কয়েকজন, যেমন হাকিমরা, জওহর ও আপনার স্বামীর ব্যক্তিগত কর্মচারীরা শুধু জানেন যে তিনি মারা গেছেন। সকলেই বিষয়টি গোপন রাখবেন। বিভিন্ন রাজ্যে বার্তাবাহক পাঠানোর পর আমি ঘোষণা করে দেব কেউ যেনো দূর্গে প্রবেশ না করেন এবং বের না হন। আমি ঘোষণা করব যে পুরানা কিল্লায় এক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে এবং শহরে যাতে তা ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।