নক্ষত্রের তালিকা অনুযায়ী, ২৪ জানুয়ারির এই সন্ধ্যার আকাশে শুক্রগ্রহ দেখার এক বিশেষ সুযোগ থাকবে। জানালা দিয়ে হুমায়ূন দেখলেন সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। প্রাসাদকক্ষ থেকে বের হয়ে বেশ কয়েকজন রাজকর্মচারীদের নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষকের দিকে গেলেন। তিনি সেখানে কারো দ্বারা বিরক্ত হতে চান না। নিজের কক্ষ থেকে দ্রুত বের হয়ে ফুলের বাগানের ভেতর দিয়ে তিনি শের মণ্ডলের দিকে গেলেন। তারপর উঁচু এবং পাথরের সিঁড়ি বেয়ে এর ছাদে ওঠলেন। চৈত্রিতে তিনি দেখলেন রাজজ্যোতির্বিদরা সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন।
হুমায়ূন কদাচিৎ আকাশ দেখতে আসেন। সোনালি ও গোলাপী আকাশ অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি এর। সেখানে সন্ধ্যা তাঁরা শুক্ৰগ্ৰহ অন্ধকার স্বর্গকে আরও সুন্দর করে তুলছে। হুমায়ুন বিমোহিত হয়ে দেখতে থাকলেন আকাশের নক্ষত্র।
পাশের রাজকীয় মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠের আওয়ার আসতে থাকলো। এতে হুমায়ুন তার পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত হলেন। তিনি আরও কিছুক্ষণ সেখানে থাকতেন কিন্তু দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিনে তিনি জনগণ ও সভাসদদের সঙ্গে নামাজ পড়েন। শুক্রগ্রহ থেকে তার চোখের পলক সরিয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। মুয়াজ্জিন তাঁর আজান প্রায় শেষ করেছেন এবং তাঁকে দ্রুত ফিরে যেতে হবে…
কিন্তু যখনই তিনি সিঁড়িতে তাঁর প্রথম পা ফেললেন, তাঁর চামড়ার জুতোর মাথায় দীর্ঘ নীল রাজকীয় পোষাক আটকে গেল। তিনি সামনের শূন্যতার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তিনি হাত বের করলেন, তবে তাঁর হাতের কাছে কিছু ধরার ছিল না। তিনি মাথা নিচের দিকে দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। তাঁর চোখের সামনে শুধু সিঁড়ি, শুধু সিঁড়ি বেয়ে উল্টো হয়ে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে একদম নিচের সিঁড়িতে এসে প্রচণ্ডভাবে লাগল তার মাথা। কিছু অংশ কেটে গেল। তারপর সবকিছু অন্ধকার, অনড় ও শান্ত।
*
প্রধান হাকিম কি এখানে এসেছেন?
তিনি আসছেন বৈরাম খান। পারস্য দেশীয়দের মতো উদ্বিগ্নতা নিয়ে অসুস্থ হুমায়ূনের স্নান আলোময় কক্ষ থেকে ধীর কণ্ঠে বললেন জওহর। অবশ্যই আমরা তাঁর জন্য এক্ষুণি পাঠিয়েছি, কিন্তু দুর্বাগ্যবশত তিনি এক আত্মীয়ের বিয়েতে এক সপ্তাহ আগে গ্রামের বাড়িতে গেছেন। আমার বার্তাবাহক এই খবর আনতেও সময় নিয়েছে। সে অবশ্য সেখানে যাবে। যা হোক, খবর এসেছে মাত্র একঘণ্টা আগে। তাঁকে পাওয়া গেছে এবং পুরানা কিল্লায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেনো সঠিক সময়ে এখানে আসেন, কারণ তাঁর দক্ষতা তাঁর খ্যাতির মতোই বিশাল…। বৈরাম খানের ঘোর ভাঙলো তিনি যখন বাহির থেকে কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তারপর দরজা খুলে দেয়া হল কালো জামা পরিহিত এক দীর্ঘদেহী ব্যক্তির জন্য, তার কাঁধে একটি বড় চামড়ার থলে।
বৈরাম খান সামনের দিকে গেলেন। আমি খান-ই-জাহান। আমি বার্তাবাহককে আপনাকে খুঁজে আনার জন্য পাঠিয়েছিলাম। আপনি দিল্লির সবচেয়ে সম্মানিত হাকিম এবং আমাদের সর্বশেষ আশা। আমাদের নিজেদের চিকিৎসকরা কোনো কিছু করতে পারেননি। তবে তাঁদের একজন আপনার কথা আমাদের জানান। তিনি জানান আপনি একবার ইসলাম শাহকে রক্ষা করেছিলেন যখন তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যান।
হাকিম মাথা নাড়লেন।
আমি বিশ্বাস করি যে ইসলাম শাহের সেবা করার কারণে তাঁকে সরিয়ে ক্ষমতা নেয়ার জন্য এই চিকিৎসায় আপনি অমত করবেন না?
একজন ডাক্তারের দায়িত্ব হল জীবন বাঁচানো। হাকিম শয্যার দিকে একপলক তাকালেন যেখানে শুয়ে রয়েছেন হুমায়ূন। তাঁর মাথা বেশ ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করা, চোখদুটি বন্ধ এবং তিনি অনড়। মহারাজকে পরীক্ষা করার আগে আমাকে বিস্তারিত বলুন, ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে এবং তিনি কীভাবে ছিলেন। আমার এই বিষয়গুলো অবশ্যই জানা উচিৎ।
বলার তেমন কিছু নেই। তিনদিন আগে তিনি একটি পাথরের সিঁড়ি থেকে পড়ে যান। একদম নিচের সিঁড়ির সাথে তিনি মাথায় আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন। সিঁড়ির পার্শ্বদিক ছিল শক্ত ও ধারালো। সভাসদরা তাঁকে রক্তাক্ত মাথায় উদ্ধার করেন এবং অজ্ঞান অবস্থায় প্রাসাদে নিয়ে আসেন। আমাদের হাকিমরা তাকে দেখেছেন এবং কপালের ডান পাশে গভীর আঘাতে ক্ষত খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর মুখ ও ডান কান দিয়েও রক্ত ঝরছিল। তখন থেকে তিনি জ্ঞান ফিরে পেয়ে বারবার আবারও অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। কখনো হঠাৎ যদি তাঁর জ্ঞানও আসছে, তিনি কাউকেই চিনতে পারছেন না, নিজের পূত্র ও সম্রাজ্ঞিকেও চিনতে পারছেন না।
গভীর ভাবনার সঙ্গে মাথা নাড়লেন হাকিম। তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং শান্তভাবে বিছানা চাদর নাড়লেন। হুমায়ুন কোনো সাড়া দিলেন না। মাথা ঝুঁকিয়ে চিকিৎসক তাঁর হৃদস্পন্দন যাচাই করতে চাইলেন। তারপর তাঁর একটি চোখের পাতা তুললেন, এবং এরপর আরেকটি তুললেন। তাঁর মুখভঙ্গিতে এক ধরনের হতাশা ফুটে উঠল। তিনি হুমায়ূনের মাথা কয়েক ইঞ্চি উপরে টেনে তুললেন এবং তাঁর কপালের একাংশ দেখলেন, যা কাটা ও বিবর্ণ। হুমায়ূন অল্পক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরে পেলেন, তবে কোনো শব্দ করলেন না।
হাকিম তখনও তাঁর আঘাতস্থানটি দেখছিলেন। আকবর তখন নারীদের কক্ষ থেকে অসুস্থ পিতার কক্ষে ফিরলেন। সেখানে তিনি তাঁর মা হামিদাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন। তিনি পিতাকে এভাবে অসহায় শুয়ে থাকতে দেখে বিমর্ষ হলেন। একইসঙ্গে তিনি আর দূরে থাকতে পারলেন না। আঘাত পাওয়ার পর বাহাত্তোর ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তিনি হুমায়ূনের কাছাকাছি থেকে তাঁর আরোগ্য কামনা করছেন। তিনি হাকিমকে বললেন, দয়া করে, আপনি অবশ্যই তাঁকে সারিয়ে তুলবেন। আমার পিতার জীবন ফিরিয়ে দেবেন।