*
সেই রাতে হামিদা ও হুমায়ুনে সঙ্গে হেরেমে খাবার খেলেন আকবর। যখন হুমায়ূন তাঁর অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী আর সুদর্শন, শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী ছেলেকে দেখলেন, তাঁর বুকটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল। অবশেষে যেনো তাঁর জীবনের সকল গৌরব সেই স্থানটিতেই ছড়িয়ে পড়ল। স্রস্টা তাঁর অশেষ দয়ায় যে সাম্রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা এখন নিরাপদ এবং এই সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি ঘটাবেন তার পাশে থাকা পূত্র আকবর। একদিন আকবরই সাম্রাজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ সামনে থেকে পরিচালনা করবেন। মোগল সাম্রাজ্য সমুদ্রের পর সমুদ্র ছাড়িয়ে যাবে।
হামিদাকেও বেশ খুশি মনে হচ্ছিল। তার মুখে নতুন এক আলোর আভা দেখা যাচ্ছিল এবং তার রেশমের কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীরের নম্র ভাঁজগুলোও ভেসে উঠছিল। কৈশোরের দিনগুলোর চেয়ে তার দেহে এখন অনেক বেশি ভোগবিলাসিতার ছাপ। আগের চেয়ে বেশি সুন্দরীও তিনি। আজ রাতে কালো চুলের মধ্যে নীলকান্ত মনির সঙ্গে হীরের টুকরো লাগিয়ে সেজেছেন তিনি। সেখানে হীরা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অনাচ্ছাদিত নাভীতে একটি নীল কান্ত মনিও লাগিয়েছেন হামিদা। পরেছেন একটু ঢিলেঢালা পায়জামা। উপরে একটি জামা যা তাঁর শরীরের সঙ্গে লেগে আছে এবং স্ফিত স্তনদুটিকে অনেকটা স্পষ্ট করে তুলেছে।
নৈশভোজের পর আকবর চলে গেলে হামিদাকে জিজ্ঞেস করেন হুমায়ুন, হে আমার সম্রাজ্ঞী, আপনার কেমন লাগল?
আমি আপনাকে বহুবার বলেছি তিনি হাসলেন খুবই ভালো লেগেছে। শত শত রাজকর্মকর্তা কর্মচারি… আমার চিরায়ত অপেক্ষা… আমার জীবনে আমি কোনো কিছু কল্পনা করা বা আকাঙ্খা করতে পারি। কিন্তু সবকিছুর পর আমাকে যে বিষয়টি বেশি খুশি করে তা হলো আমাদের সন্তান নিরাপদভাবে ফিরে এসেছে। সে। আমাকে এই আনন্দে পুর্ণ করেছে। এটা ভাবা এখনও অদ্ভুত মনে হয় যে আমাদের কাছ থেকে নেয়ার পর যখন হিন্দাল তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিল- আকবরকে মন হচ্ছিল যেন সে আমাকে চেনে না। সে মাহাম আগাকে নিয়ে ঈর্ষাণিত ছিল, আমি দেখলাম সে তার হাত কীভাবে আগার দিকে এগিয়ে দিল এবং তার জন্য হাসল, আমার দিকে নয়। আমি তখন নিজের প্রতি খুব ক্ষুদ্ধ হয়েছিলাম, নিজের ঈর্ষার জন্যও ছিলাম চরম লজ্জিত। বীর মহাম আগার কাছ থেকে আমরা সবকিছুই প্রায় পেয়েছি… তবে এখন সবই অতীত। এখন আমি মনে করি আকবরের মাথায় যে ভাবনাই আসুক আমি তা উপলব্ধি করতে পারি। আমি তাঁর সকল উচ্চাকাঙ্খ ও অভিলাস বুঝতে পারি।
.
আমি স্মরণ করতে পারছি, বিবাহের প্রথম রাতের পর সকালে আপনি আমাকে বলেছিলেন- আপনি জানেন আপনি এক পূত্র সন্তানের জন্ম দেবেন। আর একদিন এবং সেই সন্তান হবে এক শ্রেষ্ঠ শাসক… আপনি ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে এখন কী দেখছেন?
আকবরের জন্মই ছিল শেষ বিষয় যা আমি আগেই স্পষ্টভাবে আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও আমার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে নারী হিসেবে আমি আধ্যাত্বিক ক্ষমতা পেয়েছি, সেগুলো আমাকে এখন অনেকটাই ছেড়ে গেছে… তবে ওই ভবিষ্যৎ দর্শনটাই ছিল সবচেয়ে উত্তম। ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা সবসময় সুখ নিয়ে আসতে নাও পারে… কখনো না দেখাটাও ভাল…
৪.৮ স্বর্গের সোপানশ্রেণী
২৮. স্বর্গের সোপানশ্রেণী
নতুন পাঠাগারের পরিকল্পনার একটি তালিকা নিজ কক্ষে বসে পড়ছিলেন হুমায়ূন। বিকেলে তালিকাটি তার স্থপতিরা দিয়ে গেছেন। বিকেলের ম্লান অথচ স্বচ্ছ আলো লাল পাথর আর দুধের মতো সাদা মার্বেল পাথরের প্রাসাদের গায়ে এসে পড়ছে। চারদিকে প্রবেশ দ্বারের গায়ে হুমায়ূনের প্রিয় ইরানী কবিদের পংক্তিমালা লেখা আছে। একদিন হুমায়ূন ভাবলেন তাঁর পূর্বসূরিদের দুর্বল সংগ্রহকে ছাড়িয়ে যাবে তাঁর পাঠাগারের সংগ্রহ। সেখানে থাকবে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি একটি বাক্সে তাঁর বাবার জীবনের বিভিন্ন স্মৃতিকথা সম্বলিত হলুদ মলাটের বই।
কাবুলে বাবর সুন্দর একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেছেন এবং সেখানে বেশ কিছু সুন্দর বাগানও করেছেন। কিন্তু হিন্দুস্তানে কোনো স্থাপত্যকীর্তি রেখে যাওয়ার সময় তার হয়নি। হুমায়ূন সে সুযোগ পেয়ে খুশি। সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি এখনও বেশ শক্তসামর্থ্য। তিনি একটি পাঠাগারের পরিকল্পনা করছেন। এটি হবে যমুনা নদীর তীরে। এ নিয়ে একটি স্থানও নির্ধারণ করেছেন তিনি। পাঠাগারের চারপাশে থাকবে বিভিন্ন ফলের গাছ যেমন লেবু, কমলা, ডালিম। আরও থাকবে বিভিন্ন সুগন্ধি ফুলের বাগান।
একইসঙ্গে তিনি আনন্দিত যে শের মন্ডলের ছাদে তিনি একটি পর্যবেক্ষক স্থাপন করেছেন। পুরানা কিল্লার উঠানে এই অষ্টভুজটি স্থাপন করেন শের শাহ, যার কাজ প্রায় শেষের পথে। হিন্দুস্তানের লোকজন এটাকে বলেন চৈত্রি। সাদা থাম দিয়ে এটি দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এখান থেকেই আকাশের তারাদের ভালো করে দেখা যায়। মহাকাশ দেখার জন্য তিনি এগুলো বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তৈমুরের নাতি উগলুকের লেখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই জিজ-ই গোরকানির একটি কপিও তাঁর সংগ্রহে রয়েছে। এতে নক্ষত্রের স্বর্গীয় স্থানের কথা উল্লেখ রয়েছে। নতুন রাজকীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য সকলেই প্রস্তুত।