হুমায়ূন বৈরাম খানকে উপস্থিত সভাসদদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ করে দিলেন। পরবর্তী ভরা পুর্ণিমার রাতে আমরা পুরানা কিল্লায় অনেকগুলো প্রদীপ ও মোমবাতি দিয়ে আলো জ্বালব। এই আলোর তেজ পুর্ণিমার জ্যোৎস্নাকেও ম্লান করে দেবে। সে রাতে আমরা বিজয়কে উদযাপন করতে ভোজের আয়োজন করব। হুমায়ূন আবারও তার সভাসদদের দিকে ফিরে তাকালেন। আমার প্রিয় পূত্রকে এবার আমার সামনে নিয়ে আসো।
আকবর সামনে আসার পর হুমায়ূন তাঁর দিকে ভালোবাসা ও গর্ব নিয়ে তাকালেন। বেশ কয়েক মাস পর পূত্রের সঙ্গে পিতার সাক্ষাত। বেশ কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে আকবরের মধ্যে। সবুজ কাপড়ের ওপর তাঁকে আগের চেয়ে লম্বা এবং তাঁর বৃহৎ বক্ষদেশ, দৃঢ় পেশিবহুল তরুণ হিসেবে দেখা যাচ্ছিল। হুমায়ূন লক্ষ্য করলেন তার মধ্যে এতোটা উৎফুল্লতা নেই। যখনই পুত্র আকবর কাছে আসলেন এবং সম্মানার্থে তাঁর ডানহাতটি নিয়ে বুকে লাগালেন হুমায়ূন, তিনি দেখলেন তার একটি হাতে ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। হুমায়ূন প্রশ্ন করার আগেই বৈরাম খান এই আঘাত সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন।
মহারাজ, আপনার পরামর্শ অনুযায়ি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলো চলাকালে রাজপূত্রকে রক্ষীরা বেশ ভালোভাবে খেয়াল রেখেছেন। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা সিকন্দর শাহকে একদম ছন্নবিচ্ছন্ন করে দেই। আমার সহযোদ্ধারা জানায়, তারা পর্বতের পাশে একদল সৈন্যের বিচরণ লক্ষ্য করেছে। প্রায় ১ হাজার সেনা বাহিনীর একটি দল নিয়ে আমি সেই সৈন্য বাহিনীর মোকাবেলা করা সিদ্ধান্ত নেই। এরসঙ্গে বেশ কিছু অস্ত্রের মজুত নিয়ে আকবরকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, যাতে তিনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। আমি ভেবেছিলাম ওই সৈন্য বাহিনী হয়তো সেখানে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। আমরা একটি গিরিপথ ধরে যাই। সেখানে হঠাৎ পাথর ধ্বসের ঘটনা ঘটে। সে সময় পাথরের টুকরো পড়া শুরু হয়। তখন আমাদের তিন সৈনা নিহত হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের অধিকাংশ সৈন্য দল সেই স্থান থেকে সামনে চলে যায়, তবে আমাদের শেষ একশ সৈন্য মূল্য বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। তখন অন্ধকার নেমে আসছিল এবং আরও পাথর পতনের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। যারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমি তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম, তারা যে। পথে এসেছে সে পথে যেনো ফিরে যায়। আমি তখন এই গিরিখাতের সরু পথ থেকে সৈন্যদের নিয়ে বের হয়ে আসি। আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী সৈন্য গিরিপথ বন্ধ করে দেয়া পাথরের স্তূপ সরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা জানতে পারি, ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এই কাজ শেষ করতে পারব না… আমি রাজপূত্রের জন্য সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ি, তিনি তাঁর দুদ্ধভাইয়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সেই একশ সৈনের মধ্যে ছিলেন। তবে … বৈরাম খান থামলেন। রাজপূত্রকেই তাঁর গল্পটি বলার সূযোগ দেয়া উচিৎ…
আমি শুনতে পেলাম বৈরাম খান চিৎকার করে বললেন গিরিপথ থেকে বের হয়ে যেতে। আকবর আগ্রহের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন। কিন্তু আমরা আমাদের রসদগুলো নিয়ে এতোদ্রুত ফেরার সুযোগ পাইনি, গিরিপথটি ছিল খুবই সংকীর্ণ হঠাৎ বেশ কিছু লোক আমাদের ওপর হামলা চালালো। তারা ছিল পাথরের ওপর। নিচ থেকে খুব কমই আমরা দেখতে পাই। আমরা দেখলাম সিকন্দর শাহের সৈন্যদের। তাদের কাছে তেমন অস্ত্রসস্ত্র নেই। কোনো মুখোশ ছিল না। শুধু তীর আর ধনুক। আমরা তাদেরকে প্রথমে পর্বতের উপজাতি গোষ্ঠি মনে করেছিলাম, যারা আমাদের এই পথে যাওয়াটা লক্ষ্য করছে এবং লুণ্ঠন করার চিন্তা করছে। তারা আমাদের ওপর পাথরও ছুঁড়ে মারতে পারে… তারা যারাই হোক, তাঁদের ধনুক আর বর্শা কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের চারপাশে বেশ ঘনভাবে পড়তে থাকল। আমাদের বেশ কয়েকজন এতে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন।
.
আমি আমার সৈন্য দলকে বললাম ওয়াগনের পেছনে গিয়ে অবস্থান করতে। হামলাকারিদের ওপর আমাদের সঙ্গে থাকা কয়েকটি বন্দুকের গুলি ছুড়ারও নির্দেশ দিলাম আমি। তাদের চোখে নিরাশায় অস্তাচলের সূর্যের হলুদাভ আভা। তবে সেই বন্দুকের গুলি ছিল হামলাকারীদের ভয় দেখানো জন্য যথেষ্ট। কমপক্ষে তাদের একজনকে আমার পেলাম। তাঁর শরীর নিচে পড়ে গেল। আমরা দেখলাম তাঁর মাথায় একটি বন্দুকের গুলি। আমরা যদিও সারা রাত নিজেদের একটু সুরক্ষিত রাখতে আড়ালে অবস্থান করছিলাম, সে রাতে তারা আর ফিরে আসেনি। পরেরদিন সকালে পাথর সরানোর পর আমরা মুল সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেই।
আর আপনার হাত?
এটা আমার প্রথম যুদ্ধের আঘাত একটি তীরের আঘাত। আদম খান এটি আসতে দেখে আমাকে একপাশে সরিয়ে নেন। তা না হলে এটা আমার দেহে আঘাত হানতে পারত… আকবরের কাজল চোখে জল চলে এলো- অনেকটা হামিদার মতো, কারণ তিনি একটি সৈন্য দলকে রক্ষা করেছেন।
আপনি নিজেকে বীরত্বের সঙ্গে রক্ষা করেছেন বললেন হুমায়ূন। সিংহাসনের ডান দিকে গ্রীলের আড়াল থেকে হামিদা এসব দেখছিলেন ও শুনছিলেন। তবে মাতৃত্বের কারণে ভয় সৃষ্টির পরও তিনি আকবরকে নিয়ে গর্বিত হয়েছেন। সংকটের মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে বেঁচে থাকার জন্য যে অপরিহার্য দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন