মহারাজ, মহারানী হামিদার কাফেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরে রয়েছে। এক ঘোষণা হুমায়ূনের ভাবনাকে খণ্ডিত করে দিল। তখন তাঁর হৃদয় কেঁপে ওঠল। তিনি জানেন, তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন রাজ্যে সফর করছেন। কিন্তু এতো দ্রুত তিনি এখানে ফিরে আসলেন, যা তাকে খানিকটা বিস্মিত করেছে। তিনি দাঁড়ালেন। তার হৃদয়টা আনন্দে ভরে গেল। কারণ প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। আমার রাজকীয় পোষাক এনে দাও। আমি আমার স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে ভালো পোষাকে সাজতে চাই। যদিও পরে সে তার উজ্জল্যে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন হুমায়ূন।
পুরানা কিল্লার পশ্চিম ফটকের ওপর থেকে হামিদার ধীরগতির কাফেলা দেখছিলেন হুমায়ূন। এই ফটকটি ছিল অন্যান্য ফটকের চেয়ে বেশ জাকজমকপূর্ণ। সাদা মারবেল পাথর দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। দুই পাশে দুটি উঁচু চৌকিঘর। আর এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করবেন হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাজ্ঞি হামিদা। যে হাতির ওপরে করে তিনি আসছেন সেটাতে দামি কাপড়ের ওপর লাগানো আছে পাতলা স্বর্ণের আস্তরণ। এগুলো মাঝেমধ্যে ঝলকে উঠছে। যখনই এটি পশ্চিম ফটকের নিচে চলে আসল, চৌকিঘর থেকে সজোরে তূর্যধ্বনী উঠতে শুরু হল। উপস্থিত সবাই গুচ্ছগুচ্ছ গোলাপ ছুঁড়তে শুরু করলেন। হুমায়ূন দূর্গের ভেতরে একটি ফাঁকা স্থানে নেমে আসলেন। সেখানে একটি বড় সবুজ মখমলের তাবু তৈরি করা হয়েছে। সবুজ সিল্কের ফিতা দিয়ে এটি আচ্ছাদিত। এর একটি প্রবেশ পথ আছে যেখানে ঝুলে আছে সোনালি ফিতা। তাবুর ভেতরে রাখা হয়েছে বড় একটি মার্বেল পাথরের খণ্ড, যার উপরিভাগ সমান। গোপনীয়তার মধ্যে হামিদ নেমে আসার জন্য এই আয়োজন করা হয়।
হামিদার হাতি এখন প্রাসাদের উঠানে এসে হাজির হচ্ছে। মাহুত হাতির গলার মধ্যে বসে রয়েছেন এবং সতর্কভাবে তাবুর দিকে হাতিটিকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন। তারপর প্রথমে তিনি হাতের ধাতু নির্মিত সরু লাটি দিয়ে হাতিটিকে প্রথমে ডান দিকে এবং পরে বামদিকে নির্দেশ করলেন। তারপর হাতিটি মার্বেলের বড় পাথরটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। যেইমাত্র হাতিটি নিচু হল, মাহুত নেমে গিয়ে একপাশে বিনিত ভঙ্গিমায় দাঁড়ালেন। হুমায়ূন দেখলেন, তাঁর স্ত্রী পাথরের ওপর নরম পায়ে নামছেন। তাঁর জামাকাপড়ের স্বর্ণখণ্ডগুলো ঝলকে উঠছিল।
যেহেতু হুমায়ূনের দিকে চেয়ে তিনি হাসলেন, স্বর্ণ খচিত পোষাকে হামিদাকে আগের চেয়ে আরও আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল। তাঁর দীর্ঘ কালো সুগন্ধী চুল কাঁধের ওপর এসে পড়ছিল এবং এগুলো তার স্তনের ওপর ওঠানামা করছিল। তার গলায় মনি মুক্তার হার যা অনেক বিপদেও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
মাউত (হাতির পরিচালক) ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের উদ্দেশ্যে হুমায়ূন বললেন, এখন যাও। যখনই তারা একাকী হয়ে গেলেন, তিনি হামিদাকে মার্বেলে সমতল পাথর থেকে নামিয়ে আনলেন এবং তাঁকে তাঁর সামনে দাঁড় করালেন। তিনি বললেন, আমার রানী, আমার সম্রাজ্ঞী।
হামিদাকে নিয়ে সে রাতে যমুনা নদীর তীরে গড়া প্রাসাদে কাটালেন হুমায়ুন। একসময় ইসলাম শাহের হেরেমের মতো গড়ে ছিলেন এক প্রাসাদ। সেখানে দেয়ালে কাঁচের ছোট ছোট টুকরো লাগানো রয়েছে। মোমের আলো এই কাঁচের টুকরোগুলোতে পড়ে চারিদিকে ছড়িয়ে যেতো। সোনার থালায় পুড়ানো সুগন্ধি চন্দনের ঘ্রাণ আসছে ঘরের প্রত্যেক কোনো থেকে। একইসঙ্গে মার্বেলের ঝর্ণা থেকে আসছে সুগন্ধী জলের ঘ্রাণ যেখানে গোলাপের পাপড়ি ফেলা হয়েছে।
শুধু গলার হার ছাড়া সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে পড়েন হামিদা। হুমায়ুন তার কোমল ঠোঁটে হাত বুলায়ে দেন। অন্তত আমি আপনাকে সেটা দিতে পারি যা দেয়ার প্রতিজ্ঞা আপনার কাছে আমি করেছি। রাজস্তানের মরুভূমিতে যুদ্ধ চলাকালে মাঝেমধ্যে রাতে যখন আমি ঘুমোতে পারতাম না, তাকিয়ে থাকতাম আকাশের তারার দিকে, তারাগুলো ঘুরে ফিরত, আমি তাতে সামান্য ব্যাথার প্রশমন পেতাম। কিন্তু আপনি আমার ব্যাথার সবচেয়ে বড় প্রশমন।
হামিদা হাসতেন, আমি এখনও মনে করতে পারছি কতোটা আশ্চর্য হয়েছে আমার বাবা যখন আমাকে জানালেন আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন… আমি শুধু আপনাকে দূর থেকে দেখেছি… আপনাকে দেবতার মতো মনে হতো… আমাদের বাসর রাতেও আমি বিচলিত ছিলাম, কিন্তু যখন আপনি আমার কাছে আসলেন, আমি দেখলাম আমার জন্য আপনার জ্বলন্ত ভালোবাসা আর আমি জানতাম আপনি আমার অংশে পরিণত হবেন… আপনি আমার জীবন…
আর আপনি আমার… তবে আমাকে আবার প্রমাণ করতে দিন যে আমি আসলেই মানুষ, দেবতা নই। হুমায়ূন যখন হামিদাকে জড়িয়ে ধরলেন, তিনি দেখলেন তার দুটি চোখে সম্মতির মৃদু দিপ্তী।
*
মহারাজ, এক পত্রবাহক বৈরাম খানের কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছেন।
তাঁকে এক্ষুনি আমার কাছে নিয়ে আসো। নিজ কক্ষে পায়চারি করছিলেন হুমায়ুন। অবশেষে… কিন্তু কি খবর নিয়ে এসেছেন সেই ব্যক্তি? হুমায়ূনের শ্রেষ্ঠত্বের গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়ানো শক্তির বিরুদ্ধে গত কয়েক মাস আগে বৈরাম খান বিশ হাজার সেনার নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়েছেন। সর্বশেষ শিরহিন্দে যুদ্ধের পর সিকন্দর শাহ হিমালয়ের পাদদেশে পালিয়ে যান। তিনি আবারও পাঞ্জাবের সমতল ভূমিতে এসেছেন এবং সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। বৈরাম খানের আগের রিপোর্ট ছিল বেশ সাহস যোগানোর মতো, এতে সিকন্দর শাহের বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে ঘায়েল করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সিকন্দর শাহ আবারও পার্বত্যাঞ্চলে পালিয়ে যান। তারপর থেকে সবকিছু বেশ নীরব।