আব্বাজান, মুখে চওড়া হাসি নিয়ে আকবর জীবনে প্রথম হুমায়ুনের আগে কথা বলে, সোয়া ঘন্টা আগে কাবুল থেকে হিন্দুস্তানের ডাকবহনকারী এক বার্তাবাহক এসেছে। সে আমাদের জন্য আমার আম্মাজানের দুটো চিঠি নিয়ে এসেছে। শিরহিন্দের যুদ্ধের পরে আপনি যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী তিনি ইতিমধ্যে আমাদের সাথে মিলিত হবার জন্য কাবুল থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। বর্ষার কারণে বিলম্ব না হলে আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের ভিতরে তিনি দিল্লী এসে পৌঁছাবেন।
হুমায়ুন তার মনের ভেতরে একটা হাফ ছাড়া অনুভূতি টের পায়। হামিদার উপস্থিতি তার আনন্দের মাত্রাকে পূর্ণতা দেবে। চৌদ্দবছর আগে তাঁদের বিয়ের সময়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি, দিল্লী আর আগ্রার ম্রাজ্ঞীর মর্যাদা সে তাঁকে দেবে, যত দ্রুত পূরণ করা যায় ততই মঙ্গল। আকবর এটা একটা দারুণ সুসংবাদ। আমাদের অবিলম্বে তার সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে দ্রুত এখানে নিয়ে আসবার জন্য একদল সুসজ্জিত সৈন্য প্রেরণের আদেশ দেয়া উচিত।
হুমায়ুন তারপরে আকবরকে সাথে নিয়ে আড়াইশ গজ দূরে যেখানে দুটো রাজকীয় হাতি হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করছে সেদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। জওহর আর আধম খান যারা তাদের সাথে হাতির পিঠে আরোহন করবে কয়েক পা পেছনে থেকে ভক্তিভরে অনুসরণ করে। বৃষ্টি কয়েকদিন বন্ধ থাকায় তারা যখন হাঁটছে তখন পরিচারকেরা তাঁদের মাথায় যেন রোদ না লাগে সেজন্য রেশমের চাঁদোয়া ধরে থাকে। অন্যেরা ময়ূরের পালকগুচ্ছ আন্দোলিত করে তাদের বাতাস করতে এবং গুনগুন করতে থাকা মশা তাড়াতে, যা শিবিরের চারপাশে এখনও জমে থাকা কাদার কারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তারা হাতির কাছে পৌঁছালে, হুমায়ুন সোনার একটা সিঁড়ি দিয়ে দুটোর ভিতরে যেটা বড় সেটার পিঠে উঠে যায়। তাঁকে অনুসরণ করে জওহর আর সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একজন দেহরক্ষী যারা দুজনেই তার পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। হাওদায় খচিত রত্নসমূহ- যার বেশীরভাগই লাল রঙের তামড়ি আর নীলকান্তমণি- প্রথম হাতিটা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে, সামান্য ছোট দ্বিতীয় হাতিটা আকবর, আধম খান আর আরেকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এরপরেই উঠে দাঁড়ায়। আকবর তার দুধ-ভাইয়ের সাথে এমন ভাবে গল্প করছে যেন তারা শিকার করতে যাচ্ছে।
হাতি দুটো একসাথে তাদের অন্যান্য সহযাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকা একটা সারির দিকে ধীরে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন একটা হাওদায় বৈরাম খানকে দেখতে পায়, পার্সী দরবারের রীতিতে উপবিষ্ট। তার পাশেই রয়েছে তাঁর সেই তরুণ কৰ্চি বেচারার উরুর ক্ষত যদিও সেরে গিয়েছে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে রক্তপাত বন্ধের জন্য ক্ষতস্থান পোড়াবার যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি প্রয়োগের পরেই এবং এখন থেকে তাঁকে আজীবন খুড়িয়েই হাঁটতে হবে। বৈরাম খানের ঠিক পেছনের হাতিতেই রয়েছে জাহিদ খান এবং হুমায়ুনের আদেশে একেবারে সামনের হাতিতে রয়েছে আহমেদ খান। এই সম্মান আপনার প্রাপ্য যখন চারিদিকে কেবল বিপদ আর মর্যাদার কোনো অবকাশ ছিল না তখনও আপনি সবসময়ে পথ দেখিয়েছেন, সে তাকে বলে।
হাতির ঠিক পরেই রয়েছে মুস্তাফা আগুনের অশ্বারোহী বাহিনী। হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য তাঁর পুরো অভিযানে আরো যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেইসব সাধারণ মানুষদের কথা চিন্তা করে। সে একহাতবিশিষ্ট ওয়াজিম পাঠানের কথা ভাবে এমনকি ভিস্তি নিজামের কথাও তার মনে পড়ে কিন্তু কামরান পরাজিত হবার পরে ওয়াজিম খান তার গ্রামেই মোড়ল হিসাবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং নিজামকে খোঁজার সময় হয়নি। হুমায়ুন তারপরে জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে আদেশ দেয়। অগ্রসর হওয়া যাক।
হুমায়ুনের আদেশ রাজকীয় শোভাযাত্রার শুরুতে অবস্থানকারী হুমায়ুন আর মোগল রাজবংশের সাথে সাথে তৈমূরের অতিকায় নিশানবাহকদের পৌঁছে দেয়া হয়। তাঁরা আধ মাইল দূরে অবস্থিত বেলে পাথরের তৈরী অতিকায় তোরণদ্বারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে তাদের ঠিক পেছনেই অবস্থানরত তূর্য আর দামামাবাদকের দল বাজনা শুরু করে, প্রথমে ধীর লয়ে তারপরে প্রবল উদ্দামে যখন তারা তোরণদ্বারের কাছে সমবেত জনতার নিকটবর্তী হয় যাদের হুমায়ুনের সৈন্যরা শিবির থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল কিন্তু এখন তারা রাজকীয় শোভাযাত্রার খেজুর পাতা এবং ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরী দড়ির দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুমায়ুন সামনে এগিয়ে যাবার সময় সূর্যের আলোয় সামনের অশ্বারোহীদের বুকের বর্ম আর ঘোড়ার সাজ আর সামনের হাওদাগুলোকে চকচক করতে দেখে এবং লাগামের সাথে যুক্ত ক্ষুদ্র ঘন্টার ধ্বনি আর ঘোড়ার চিঁহি শব্দ মন দিয়ে শোনে- যা সমবেত জনতার উল্লসিক চিৎকারে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছে। তারপরে, আবেগ আপুত হৃদয়ে সে মুখ তুলে উপরের নীল নির্মেঘ আকাশের দিকে তাকায় এবং দেখে বা তাঁর মনে হয় সে দেখেছে- মোগল মহত্বের প্রতীক দুটো ঈগল আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। হিন্দুস্তান এখন তার। মোগল সিংহাসন সে পুনরুদ্ধার করেছে। তাঁদের রাজবংশ আজকের পরে কেবলই শক্তিশালী হবে। সে আর আকবর- বিষয়টা নিশ্চিত করবে।
৪.৭ তারকার হাসির পতন
২৭. তারকার হাসির পতন