তারকারাজির আবর্তনের মাঝে এসব কি আসলেই সত্যিকারের ভবিতব্য? আর যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এসব কিভাবে সত্যি হল? ঘটনা পরম্পরা কি আসলেই অনিবার্য, পূর্বনির্ধারিত এবং কোনো মহান শক্তি কর্তৃক পরিকল্পিত, যা অর্ন্তজ্ঞানসম্পন্ন কারো জন্য তারকারাজির মাঝে পূর্বেই লিপিবদ্ধ থাকে, যেমনটা সে একদা বিশ্বাস করতো? নাকি, বিপরীতক্রমে সে তার কল্পনায় মানুষের জীবনের যে ঘটনাবলী দেখতে পায় বলে মনে করতো এবং পরিবর্তিত পৃথিবীতে এসবের একটা ছক খুঁজতে চেষ্টা করতো এবং সেই ঘটনাগুলো কি প্রেক্ষাপটের বোধগম্য সাদৃশ্য বা কোনো সমকালীনতার কারণে সংঘটিত হয়? পারিবারিক দ্বন্দ্ব কি শাসক রাজবংশগুলোর জন্য আনুষঙ্গিক হুমকি বহন করে না? বাবরের আপন সৎ-ভাই কি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং তৈমূরের সন্তানেরা কি তাদের পিতার উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদগ্রস্থ আর বিভক্ত হয়নি? স্বপক্ষ ত্যাগ কি সবসময়ে পরাজয়ের অনুবর্তী নয় এবং মহান বিজয়ের পরে চাটুকার নতুন মিত্র? তার আব্বাজানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ এবং নিজের সংকল্পকে দৃঢ় করতে সেই শিক্ষার ব্যবহার কি তাদের দুজনের জীবনের ভিতরে সাদৃশ্যের জন্ম দেয়নি?
সে তার যৌবনে, নিয়তি নির্ধারিত ছকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করতো। সে এমন বিশ্বাসের কারণে যেন নিজের কৃতকর্ম এবং তার ফলাফলের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ থেকে কেমন বিরত থাকতো। তাঁর আলস্যকে এসব ধারণা প্রশ্রয় দিয়েছিল এবং তার সর্বোচ্চ অবস্থান তার ন্যায়সঙ্গত আর অলঙ্ঘনীয় এমন বালখিল্যসুলভ বিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত করেছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা তাঁকে পরিবর্তিত করেছে এবং এখন, পরিণত বয়সে এসে সে এমন বাহ্যিক ব্যাখ্যা সাধারণত বর্জন করে এমনকি ব্যর্থতার কারণ হিসাবেও সে একে গন্য করে থাকে। একটা মানুষের জন্মের বিষয়টা যদিও ঈশ্বরের অভিপ্রায় কিন্তু সেখান থেকে নিজের জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁর নিজের উপর এবং তার দক্ষতার যথাযথ প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। নিয়তি নির্ধারিত থাকার কারণে সে তাঁর সাম্রাজ্য পুনরায় অর্জন করেনি বরং এটা অর্জনের জন্য সে চেষ্টা করেছে, নিজের দুর্বলতাকে জয় করেছে আর সবধরনের বিলাসিতা পরিহার করে কেবল একটা লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। নিজের এই ভাবনার কারণে নিজেই গর্বিত হয়ে হিন্দুস্তান বিজয়ের পরে বাবরের সংক্ষিপ্ত শাসনকালের সাথে তুলনায় নিজের শাসনকালের বিকাশ কেমন ভাবে তুলনীয় হবে ভাবতে ভাবতে হুমায়ুন ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুম ভেঙে উঠে সে জওহরকে ডাকার প্রস্তুতি নেবার সময় পূর্বদিনের সন্ধ্যাবেলার ভাবনাগুলো আরেকবার চিন্তা করে। সে যখন এসব ভাবছে তখন তারকারাজির একটা বইয়ের দিকে তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সে মুচকি হাসে। সে এখন যদিও বিশ্বাস করে না যে তারকারাজি জীবনের সব গোপন রহস্য ধারণ করে রয়েছে, কিন্তু তাঁদের আবর্তন এবং তাঁর পেছনের কারণ আজও তার বুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করে। জ্যোতিষবিদ্যার আকর্ষণ তার কাছে কখনও ম্লান হবে না।
দুই ঘন্টা পরে, জওহর হুমায়ুনকে সেদিনের জন্য পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত করার পরে তার সামনে একটা লম্বা বার্ণিশ করা আয়না ধরে যাতে হুমায়ুন নিজের রাজকীয় পরিচ্ছদ খুটিয়ে দেখতে পারে। সে আয়নায় প্রথমবার যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিক তখনকার মতোই সাতচল্লিশ বছরের একজন পুরুষের ঋজু, পেষল অবয়ব দেখতে পায় যদিও তাঁর কপালের দুপাশের চুলে হাল্কা রূপালি ঝোপ দেখা দিয়েছে এবং চোখের চারপাশে আর হাসির সময় ঠোঁটের কোণে হাল্কা বলিরেখা পড়েছে।
তার পরণে সোনার জরির কারুকার্য করা সূর্য আর নক্ষত্রখচিত আজানুলম্বিত আলখাল্লা এবং কিনারায় মূল্যবান মুক্তোখচিত একটা দুধ সাদা রঙের টিউনিক এবং একই রঙের পাতলুন। খাঁটি স্বর্ণের তৈরী একটা পরিকর তাঁর কোমরে এবং সেখানে রত্নখচিত ময়ানে ঝুলছে আলমগীর। তাঁর পায়ের রয়েছে বাদামী বর্ণের সামনের দিকটা বাঁকানো এবং তীক্ষ্ণ একটা নাগড়া এবং যার গোড়ালীর পেছনের দিকে রয়েছে সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা অতিকায় তারকা। তার মাথায় রয়েছে সোনার জরি দিয়ে বোনা একটা কাপড়ের পাগড়ি যার চূড়ায় একটা ময়ূরের পালক যুক্ত রয়েছে এবং গলার সোনার উপর রুবিখচিত ভারী মালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রুবির বলয় রয়েছে পাগড়ির মাঝামাঝি স্থানে। তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয় রয়েছে তাঁর তর্জনীতে এবং অন্য আঙ্গুলে পান্না আর নীলা ঝলসাচ্ছে।
জওহর, তোমাকে ধন্যবাদ; তুমি আমাকে একজন সম্রাটের তুল্য পোষাকেই সজ্জিত করেছে। আমি একটা জিনিষ শিখেছি যে শক্তিশালী আর কর্তৃত্বপরায়ণ হবার সাথে সাথে মানুষের সামনে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আনুগত্য আর আত্মবিশ্বাস এর ফলে বৃদ্ধি পায়… কিন্তু এসব সাজসজ্জা এখন অনেক হয়েছে। আমার চোখেরমণি কোথায়?
বাইরে অপেক্ষা করছে।
তাকে ভেতরে আসতে বল।
আকবর কিছুক্ষণ পরেই পুরোপুরি সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত দুজন দেহরক্ষী তাবুর সামনের পর্দা তুলে ধরলে ভেতরে প্রবেশ করে। আকবরের বয়স এখনও পুরোপুরি তের বছরও হয়নি কিন্তু এরই ভিতরে সে তাঁর আব্বাজানের মতোই লম্বা আর চওড়া কাঁধের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তার পরণেও বেগুনী আর গোলাপী রঙের রাজকীয় সাজসজ্জা যা তার তারুণ্যদীপ্ত পেষল অভিব্যক্তিই যেন ঘোষণা করছে।