সোয়া ঘন্টা পরে, সিকান্দার শাহের অবরোধকের ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয় এবং হুমায়ুনের প্রতিনিধি বাহাদুর খান নামে এক তরুণ যোদ্ধাকে সেখানে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে হুমায়ুন তার কালো ঘোড়ায় চেপে যেখানে অপেক্ষা করছে। সেদিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।
সুলতনি তারা আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে। তারা জোর কণ্ঠে জানিয়েছে যে তাঁদের মাঝে সিকান্দার শাহ নেই এবং তিনি সত্যিই আমরা আক্রমণ শুরু করা মাত্রই দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিয়ন্ত্রক তাবু ত্যাগ করেছে বটে কিন্তু তিনি পলায়নের উদ্দেশ্যেই তাবু ত্যাগ করেছিলেন। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করেছেন বলে তারা অভিযোগ জানিয়েছে আর এই কারণেই তারা আত্মসমর্পণের জন্য রাজি হয়েছে। তাঁর বেশ কয়েকজন সেনাপতি আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার ইচ্ছা পর্যন্ত ব্যক্ত করেছে।
স্বস্তি আর আনন্দের একটা যুগপৎ ধারায় হুমায়ুন জারিত হয়। তাঁর বিজয় হয়েছে। হিন্দুস্তান পুনর্দখলের পথে শেষ বাধাটাও সে অপসারিত করেছে। অবস্থাদৃষ্টে যদি মনে হয় যে সে সিকান্দার শাহকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু তারপরেও তাঁর বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সিকান্দার শাহের বিশাল বাহিনী দুই ঘন্টারও কম সময়ের ব্যবধানে পর্যদস্ত হয়েছে। যারা এখনও অক্ষত রয়েছে তারা হয় আত্মসমর্পন করেছে নতুবা পালিয়েছে। হুমায়ুন আবেগআপ্লুত ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা শুরু করে।
আমার সকল সেনাপতিকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি একটা মহান বিজয় অর্জন করেছি। হিন্দুস্তান এখন রীতিমতো আমাদের আয়ত্ত্বে হলেও সময় নষ্ট করার কোনো অবকাশ নেই। প্রথমেই আমরা আমাদের আহত যোদ্ধাদের যত্ন নেব এবং তারপরে আমাদের মৃত সঙ্গীদের সমাধিস্থ করবো কিন্তু তারপরেই আর কোনভাবে কালক্ষেপন না করে আমরা বিশাল দিল্লী শহর সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।
*
দিল্লী শহরের বেলেপাথরের তৈরী বিশাল প্রতিরক্ষা দেয়ালের ঠিক বাইরে, নিজের শিবিরের কেন্দ্রে অবস্থিত তার লাল তাবুর ভিতরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে হুমায়ুনের ঘুম ভেঙে যায়। তাকে হিন্দুস্তানের পাদিশাহ্ ঘোষণা করে, শুক্রবার জুম্মার নামাযের শেষে তাঁর নামে পঠিত খুতবা শোনার জন্য সেদিন দুপুরের পরে শহরের উঁচু তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিকভাবে শহরে প্রবেশের কথা রয়েছে। শিরহিন্দের যুদ্ধে সে জয়লাভ করার পর বর্ষার অঝোর বৃষ্টির ভিতর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে যখন দ্রুত দিল্লীর দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখন থেকে দিনগুলি দারুণ ব্যস্ততায় কেটেছে। পথে স্থানীয় শাসকেরা তড়িঘড়ি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং সিংহাসনের অন্য দাবীদারদের অনুগত সৈন্যরা দল বেধে এসে আত্মসমর্পন করেছে এবং স্বেচ্ছায় হুমায়ুনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
হুমায়ুন চারদিন আগে পানিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হবার স্থান অতিক্রম করেছে। যেখানে সে তাঁর আব্বাজানের সাথে প্রথমবারের মতো হিন্দুস্তান জয় করেছিল। উনত্রিশ বছর পরে এখনও সমভূমির উপরে বাবরের তবকিদের বন্দুকের গুলিতে মারা যাওয়া সুলতান ইব্রাহিমের অতিকায় রণহস্তীর কিছু কিছু সাদা হাড় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।
গত সন্ধ্যায়, হুমায়ুন নিজের তাবুতে শুয়ে নিজের জীবনের সাথে তার আব্বাজানের জীবনের সাদৃশ্য আর ভিন্নতা নিয়ে চিন্তা করছিল। বর্ষাকালে রাতের বেলা এক অতর্কিত আক্রমণে সে তাঁর জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে শেরশাহের কাছে পরাস্ত হয়েছিল এবং সেই একই কৌশল অবলম্বন করে সে সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে তাঁর শেষ বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। উভয় যুদ্ধেই সে তার ডান হাতের উধ্বাংশে আঘাত পেয়েছে। সিকান্দার শাহের এবং অন্যান্য দাবীদারদের পক্ষত্যাগকারী সৈন্যদের যোগদানের কারণে তাঁর শেষ অভিযানের পরে নিজ বাহিনীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে শেরশাহের সাথে পরাজিত হবার পরে তাঁর সৈন্যরা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তার সৎ-ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তার পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল কিন্তু শেরশাহের পরিবার এই বিষয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আদিল শাহ তাঁর পরিবারের সাথে লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি নিজেকে দুগ্ধপোষ্য ভাস্তেকে, সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারীকে নিজের মায়ের সামনে, তাঁর নিজের বোনের সামনে হত্যা করেছে, যা করার পূর্বে কামরানও দ্বিতীয়বার চিন্তা করতো।
পানিপথে মোগলদের মহান বিজয়ের পরে হুমায়ুন কোহ-ই-নূর অর্জন করেছিল যা সে তার নিজের এবং তার বংশের দুর্বলতম সময়ে এর পুনরুত্থানের নিমিত্তে ব্যবহার করেছে। তার আব্বাজানের মতো সে তারুণ্যদীপ্ত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে কিন্তু তারপরেই বিপুল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে যা তার মনোবলের পরীক্ষা নিয়েছে। তার এবং তার পরিবারের জন্য পারস্যের সমর্থণ আর সেই সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আপোষ কাঙ্খিত সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাবরের মতোই, হিন্দুস্তান দখলের পূর্বে সে কাবুলে যতটা সময় অতিবাহিত করতে চেয়েছিল তারচেয়ে বেশী সময় অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছে।