হুমায়ুন এবার লাল পাগড়ি পরিহিত এক যোদ্ধার দিকে মনোনিবেশ করে যাকে সে খানিকটা দূরে থেকে লড়াই পরিচালনা করতে দেখে। সে ঘোড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লোকটাকে তাঁর পর্যাণের সাথে সংযুক্ত ময়ান থেকে একটা দোধারি রণকুঠার বের করতে দেখে। সে হাতটা পেছনে নিয়ে রণকুঠারটা সরাসরি হুমায়ুনের অবস্থান লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হুমায়ুন তাঁর বর্মাবৃত বাহু উঁচু করে নিজের মাথা বাঁচায় কিন্তু রণকুঠারের ধারাল ফলা তার বাহুতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত হেনে পিছলে যায়। আঘাতটা এতটাই মারাত্মক যে তাঁর বর্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বহুবছর আগে চসারের যুদ্ধে প্রাপ্ত আঘাতের স্থান পুনরায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। উজ্জ্বল বর্ণের লাল-কমলাভ রক্ত তাঁর বাহু বেয়ে হাতে পরিহিত দাস্তানা ভিজিয়ে দেয়। হুমায়ুন বিষয়টা অগ্রাহ্য করে এবং আলমগীর তখনও শক্ত করে আকড়ে ধরে থাকে এবং প্রতিপক্ষের একজনের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে সজোরে তরবারি হাকায়, তারা এতো কাছ দিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করে যে দুজনে পায়ে পায়ে ধাক্কা খায়। হুমায়ুনের তরবারির আঘাত প্রতিপক্ষের লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে সজোরে আঘাত হেনে, তাঁর কণ্ঠনালী ছিন্ন করে দেয় এবং পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পরার আগে যতটুকু সময় তার দেহটা স্থির হয়ে ঘোড়ায় বসে থাকে ততক্ষণ ফিনকি দিয়ে তাঁর দেহের ভেতর থেকে রক্ত বাতাসে ছিটকে যেতে থাকে।
সজোরে শ্বাস নিয়ে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম জোরে টেনে ধরে এবং চারপাশে তাকায়। নিয়ন্ত্রক তাবুর চারপাশের সংঘটিত যুদ্ধে সে আর তার লোকেরা জয়ী হয়েছে। সে তার বামপাশে তাকিয়ে দেখে মুস্তাফা আর্গুন আর তার সাদা পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধারা সিকান্দার শাহের একদল অশ্বারোহীকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে, অন্যদিকে তাঁর ডানপাশে বৈরাম খানের লোকেরা যাদের ভিতরে হুমায়ুন লক্ষ্য করে আকবরের দুধ-ভাই আধম খানও রয়েছে বিশাল একটা দলকে ঘিরে ফেলেছে যারা ইতিমধ্যেই অস্ত্র নামিয়ে রাখতে শুরু করেছে।
বৈরাম খান ঘোড়া নিয়ে হুমায়ুনের কাছে এগিয়ে আসে। সুলতান, আমার অধীনস্ত সেনাপতিরা আমাকে জানিয়েছে যে আমাদের অশ্বারোহীদের বিশটা বহর সিকান্দার শাহের শিবিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এবং প্রতি মিনিটে আরো অধিক সংখ্যক সৈন্যদল ভিতরে অনবরত প্রবেশ করছে। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের একটা বিশাল সংখ্যাকে অস্ত্র ধারণের পূর্বেই হত্যা করেছি এবং আরো বেশী সংখ্যককে বন্দি করেছি যদিও আতঙ্কে তাঁদের অনেকেই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালিয়েও গিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে শিবিরের তিন-চতুর্থাংশ অংশ দখল করে নিয়েছি। শত্রু সৈন্যদের একটা বিশাল অংশ অবশ্য এখনও শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম অংশে বিপুল বিক্রমের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু যোদ্ধা দাবী করেছে যে আমরা যখন প্রথম নিয়ন্ত্রক তাবু আক্রমণ করি তখন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিকে, তাদের ধারণা লোকটা সম্ভবত সিকান্দার শাহ স্বয়ং, ঐ দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছে।
আমরা তাহলে নিজেদের সংগঠিত করে নিয়ে সেই দিকে আক্রমণ জোরদার করি এবং সিকান্দার শাহ যদি সেখানেই আদতেই অবস্থান করে থাকে তাহলে তাঁকে বন্দি করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার আগে আমার এই ক্ষতস্থানটা আমার গলার উত্তরীয় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দাও, হুমায়ুন তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে রক্তাক্ত হাতটা বৈরাম খানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বৈরাম খান কয়েক মিনিটের ভিতরে হুমায়ুনের হাতের ক্ষতস্থান শক্ত করে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়, ক্ষতস্থানটা খুব একটা গভীর না হওয়ায় রক্তপাত ইতিমধ্যে মোটামুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
হুমায়ুন আর বৈরাম খান বৃষ্টির ভিতর দিয়ে শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম কোণে খানিকটা উঁচুনীচু ভূমির দিকে এগিয়ে যায়। কাদার ভিতরে উপড়ানো তাবু, উল্টানো হাড়িকুড়ি আর মানুষ এবং প্রাণীর মৃত, অর্ধমৃত দেহের মাঝ দিয়ে যেগুলো এখন লালবর্ণ ধারণ করেছে তারা এগিয়ে যায়। তারা ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী হতে যুদ্ধে হৈচৈ আর চিৎকারের আওয়াজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে যখনই দুপক্ষের কোনো সৈন্য বৃষ্টির ভিতরে বারুদ শুকনো রাখার মতো কোনো উপযুক্ত আড়ালের পেছন থেকে বারুদের থলে খুলে বন্দুকে দ্রুততার বারুদ পূর্ণ করতে পারে।
নতুন দিনের সীসার মতো বিষণ্ণ আলো ফুটতে শুরু করায় হুমায়ুন দেখে যে সিকান্দার শাহের লোকেরা দৃঢ়সংকল্পের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। তারা কয়েকটা উঁচু ঢিবির চারপাশে বেশ কিছু মালবাহী শকট উল্টে দিয়েছে, এবং তীরন্দাজ আর তবকিরা সেগুলোর সৃষ্ট আড়াল ব্যবহার করে তার পেছন থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অশ্বারোহীদের বেশ কয়েকটা দল অবরোধকের মাঝে একত্রিত হয়েছে যারা বেশ কয়েকশ গজ ব্যাপী একটা সীমানা অটুট রেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েক হাজার সৈন্য এখানে সমবেত হয়েছে। তার নিজের সৈন্যরা অবশ্য এদের পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে।
বৈরাম খান আমার লোকদের সামান্য পিছিয়ে আসতে বলেন কিন্তু সিকান্দার শাহের সৈন্যরা যেন নিচ্ছিদ্রভাবে পরিবেষ্টিত থাকে। তারা যদি অস্ত্র সমর্পণ করে সিকান্দার শাহের অবস্থান আমাদের জানায় তাহলে আমরা তাদের প্রাণ বখশের একটা সুযোগ দেব।