‘জেনানা মহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা। তুমি বলেছিলে আজ রাতের খাবারটা আমাদের সাথেই খাবে। তোমার মা অভিযোগ করছিল আজকাল বড্ড বেশী একাকী থাকছো তুমি, আমিও তার সাথে একমত।’
খানজাদা অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। দেয়ালে ঝোলান জ্বলন্ত মশাল থেকে তামাটে বর্ণের আলো এসে একটা কাটা কাটা মুখাবয়বের উপরে পড়ে যা এখন আর তার যৌবনকালের মতো তত সুন্দর নেই দেখতে কিন্তু এমন একটা মুখ যা হুমায়ুন তার তেইশ বছরের জীবনের পুরোটা সময় ভালোবেসেছে আর বিশ্বাস করেছে। খানজাদা আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতে চন্দনকাঠের হালকা সৌরভ টের পায় সে যা জেনানা মহলে কারুকার্যখচিত সোনার তশতরিতে ক্রমাগত জ্বলছে।
‘আমাকে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হচ্ছে। আমার এখনও পুরোপুরি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে আমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন।’
‘হুমায়ুন, সেটা আমি বুঝি। আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। বাবর তোমার বাবা ছিল বটে কিন্তু ভুলে যেও না আমার আদরের ছোট ভাইও ছিল সে। সে আর আমি একসাথে অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছি, এবং কখনও চিন্তা করিনি এতো শীঘিই আমরা তাকে হারাব…কিন্তু সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা।’
হুমায়ুন দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, প্রথম মুঘল সম্রাট, তার বাবাকে সে আর কখনও দেখতে পাবে না এই ভাবনায় যে তার চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে সেটা সে এমনকি খানজাদাকেও দেখাতে অনিচ্ছুক। শক্তিশালী, পোড় খাওয়া এক যোদ্ধা, যে তার যাযাবর ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে কাবুল থেকে পাহাড়ের গিরিপথের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে এসে, একটা সাম্রাজ্যের খোঁজে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেছিল, আজ মৃত, এই ভাবনাটাই কেমন অসম্ভব মনে হয়। এমনকি এই ভাবনাটা আরও বেশী অবাস্তব মনে হয় যে মাত্র তিনমাস আগে কোমরে ঈগলের মস্তক শোভিত হাতলযুক্ত তাঁর পিতার তরবারি আলমগীর আর আঙ্গুলে তাঁর পূর্ব পুরুষ তৈমুরের অঙ্গুরীয় ধারণ করে নিজেই নিজেকে মোগল সম্রাট বলে বিঘোষিত করেছে সে।
‘সবকিছু এতো বিচিত্র… অনেকটা একটা অলীক কল্পনার মতো যা থেকে প্রতিনিয়ত আশা করছি জেগে উঠব আমি।’
‘এটাই বাস্তব দুনিয়া আর তোমার উচিত একে মেনে নেয়া। বাবর যা চেয়েছিল, যার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল সে, সবকিছুর কেবল একটাই উদ্দেশ্য ছিল- একটা সাম্রাজ্য হাসিল করা এবং রাজবংশের পরম্পরার পত্তন। আমি যেমন এটা জানি তুমিও জানো- মোগলদের জন্য হিন্দুস্তান হাসিল করতে পানিপথের যুদ্ধে যখন সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্থ করেছিল সে তুমি কি তোমার পিতার পাশে সেদিন লড়াই করনি?’
হুমায়ুন নিশ্চুপ থাকে। কোনো কথা না বলে আরেকবার আকাশের দিকে তাকায় সে। যখন সে আকাশের দিকে তাকায়, স্বর্গের বুক থেকে একটা উল্কা খসে পড়ে মিলিয়ে যেতে দেখে, এর জ্বলন্ত পুচ্ছের বিন্দুমাত্র চিহ্নও থাকে না। আড়চোখে খানজাদার দিকে তাকালে দেখে যে তিনিও উল্কাপাতটা লক্ষ্য করেছেন।
‘উল্কাপাত সম্ভবত কোনো একটা কিছুর পূর্বলক্ষণ। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছে লজ্জাকরভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে আমার রাজত্ব…আমার কথা কেউ মনে রাখবে না…’।
‘তোমার বাবা যদি এখন এখানে থাকতেন তাহলে নিজের প্রতি এই ধরনের সন্দেহ আর চলচিত্ততা তাকে কুদ্ধ করতো। তোমার নিয়তিকে তুমি বরণ করে নাও বরং এটাই চাইতেন তিনি। নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে তোমার বাকি তিন সৎ-ভাইদের ভিতর থেকে একজনকে পছন্দ করতে পারতেন তিনি কিন্তু তোমাকে মনোনীত করেছেন। তুমি সবার ভিতরে বড় এটাই কারণ না- আমাদের গোত্রের লোকেরা বিষয়টা কখনও এভাবে বিবেচনা করে না। তিনি তোমাকে সবচেয়ে যোগ্য আর গুণী ভেবেছিলেন সেজন্য। হিন্দুস্তানের উপরে আমাদের আধিপত্য এখনও অনিশ্চিত- মাত্র পাঁচ বছর আগে আমরা এদেশে এসেছি এবং চারপাশ থেকে বিপদের আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে। বাবর তোমাকে নির্বাচন করেছিলেন কারণ তিনি কেবল তোমার সাহসিকতায়, যা তুমি ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করেছে, আস্থাশীল ছিলেন না বরং সেইসাথে তোমার আত্মবিশ্বাস, আর তোমার আত্মার শক্তি, আমাদের পরিবারের শাসন করার অধিকার সম্বন্ধে তোমার বিবেচনা বোধ, যা এখানে এই নতুন ভূখণ্ডে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে আর সমৃদ্ধি লাভ করতে আমাদের রাজবংশে অবশ্যই থাকতে হবে।’ খানজাদা দম নেবার জন্য থামেন।
হুমায়ুন যখন কোনো উত্তর দেয় না, তিনি মশালের আলোয় নিজের মুখ তুলে ধরেন এবং তাঁর ডান ভ্র থেকে প্রায় চিবুক পর্যন্ত নেমে আসা একটা সরু সাদা ক্ষতচিহ্নে আলতো করে নিজের আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করেন। আমি মুখে এটা কিভাবে এসেছে, আমি যখন তরুণী ছিলাম আর উজবেকদের হাতে তোমার বাবাকে সমরকন্দ তুলে দিতে হয়েছিল তখন কিভাবে তাদের গোত্রপতি সাইবানি খান আমাকে অপহরণ করেছিল আর তার ইচ্ছার কাছে আমাকে নতজানু হতে বাধ্য করেছিল। সে আমাদের মতো, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, তাদের সবাইকে ঘৃণা করতো। আমাদের বংশের কোনো যুবরাজকে অবমানিত আর তার মর্যাদাহানি তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ দিত। আমি কৃতজ্ঞ যে তাঁর হারেমে বন্দিনী অবস্থায় পুরোটা সময় আমি কখনও হতাশ হইনি… কখনও ভুলে যাইনি আমি কে বা এটা আমার দায়িত্ব যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রেখে যে আরেকটা মেয়ে যখন অতর্কিতে আক্রমণ করে আমার সৌন্দর্যের কিছুটা চুরি করেছিল, আমি এই ক্ষতচিহ্ন সম্মানের স্মারক হিসাবে ধারণ করেছিলাম- সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এখনও বেঁচে আছি এবং নিশ্চয়ই একদিন আবারও মুক্ত হব। সেই দিনটা এসেছিল সুদীর্ঘ দশ বছর পরে। আমার ভাইয়ের সাথে আমি পুনরায়– মিলিত হই আর আমার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে সাইবানি খানের করোটি দিয়ে নির্মিত একটা পানপাত্র থেকে তাঁকে পান করতে দেখে সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম আমি। হুমায়ুন আমার যেমন ছিল, তোমাকেও সেই একইরকম আত্মবিশ্বাসে আর চারিত্রিক দৃঢ়তায় বলীয়ান হতে হবে।