অবিলম্বে যথেষ্ট লোক তাঁর সাথে সমবেত হলে, হুমায়ুন দ্বিতীয়বারের মতো শত্রুর সেনাসারির দিকে ফিরতি আক্রমণ শানায়। এক ঢ্যাঙা গুজরাতি তার হাতের বাঁকান তরবারি দিয়ে তাঁকে আঘাত করলে সেটা বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং হুমায়ুনকে তাঁর পর্যাণে ছিটকে ফেলে। হুমায়ুন যখন তার পিছু হটতে থাকা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে প্রাণান্ত হচ্ছে, সেই সুযোগে গুজরাতি সেনাটা এবার তার দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসে এবং নিজের প্রতিপক্ষকে খতম করার অতি-উৎসাহে, হুমায়ুনের মস্তক বরাবর সে তার আন্দোলিত তরবারির নিশানা স্থির করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুন তরবারির আগ্রাসী ফলার নীচে ঝুঁকে যায় যা তাঁর শিরস্ত্রাণের সামান্য উপর দিয়ে বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। গুজরাতি নিজের ভারসাম্য ফিরে পাবার আগেই, হুমায়ুন দ্রুত আলমগীরের ফলা এক ধাক্কায় তাঁর উদরের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা তরবারি ফেলে নিজের ক্ষতস্থান চেপে ধরতে, হুমায়ুন ঠাণ্ডা মাথায় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিপক্ষের গলার পেছনে আঘাত করে, কাঁধ থেকে তাঁর মাথা প্রায় আলাদা করে ফেলে।
নিজের চারপাশে তাকিয়ে, আন্দোলিত লাল ধূলোর ভিতর দিয়ে হুমায়ুন দেখে যে গুজরাতি সেনাসারি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর কিছু সৈন্য আতঙ্কে ঘোড়া দাবড়ে পালাচ্ছে। সেনাসারির মাঝে অবস্থানরত অন্যেরা অবশ্য দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে, মালবাহী গাড়িগুলো রক্ষা করছে যেগুলোতে সম্ভবত কামান আর মালপত্র আছে। হুমায়ুন ভালো করেই জানে সে যদি তাদের বন্দি করতেও সক্ষম হয় তবুও সে কোনো কামান বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ সেগুলো তার বাহিনীর অগ্রসর হবার গতি মন্থর করে দেবে যাদের মূল লক্ষ্যই হল দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। অবশ্য কামানগুলো সে অকেজো করে দিতে পারে। নিজের ধমনীতে টগবগ করতে থাকা যুদ্ধের উন্মাদনার সাথে এবং তাকে অনুসরণ করার আদেশ ঘোষিত করার জন্য তাঁর তূর্যবাদককে চিৎকার করে আদেশ দিয়ে, হুমায়ুন ঝড়ের বেগে কোনো সময় নষ্ট না করে মালবাহী গাড়িগুলোর দিকে ছুটে যায়।
অকস্মাৎ একটা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের শব্দ তার কানে ভেসে আসে- তারপরে আরেকটা মাস্কেটের। গুজরাতি বন্দুকবাজদের কয়েকজন অবশেষে নিজেদের মাস্কেট কার্যক্ষম করতে সক্ষম হয়েছে এবং মালবাহী গাড়িগুলোকে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে তারা গুলিবর্ষণ করছে। হুমায়ুনের কাছ থেকে দশ গজ দূরে ছুটন্ত ঘোড়াগুলোর একটা আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং ধূলোর ভিতরে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং পিঠের আরোহীকে মাটিতে ছিটকে ফেলে, তাকে অনুসরণরত সহযোদ্ধাদের ঘোড়াগুলো তাঁকে নিজেদের খুরের তলায় পিষে ফেলার আগে সে মাটিতে শুয়ে এক মুহূর্তের জন্য ছটফট করে, তার দেহে প্রাণের শেষ স্পন্দটুকুও শেষ হয়ে যায়।
হুমায়ুন ভালো করেই জানে বন্দুকধারীরা তাদের বন্দুকে পুনরায় বারুদ ভরার আগেই তাকে মালবাহী গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছাতে হবে। আরো একবার আলমগীর আন্দোলিত করে, সে নিজের ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয় এবং প্রায় সাথে সাথে গাড়িগুলোর মাঝে গিয়ে উপস্থিত হয়। এক বন্দুকবাজকে লক্ষ্য করে সে তরবার চালনা করে যে কাঁপতে থাকা হাত দিয়ে তাঁর মাস্কেটের লম্বা নলে ধাতব বলটা একটা ইস্পাতের শলাকার সাহায্যে প্রবিষ্ট করার প্রচেষ্টায় রত। লোকটার মুখে তরবারির ফলা আঘাত হানতে, হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষ মাল বোঝাই গাড়িগুলোকে টেনে এনে কোনো ধরনের রক্ষণাত্মক বিন্যাস তৈরী করার অবকাশ পায়নি আর তাই হুমায়ুনের লোকেরা, যারা তার পেছন পেছন এসে হাজির হয়, অনায়াসে তাঁদের ঘিরে ফেলে এবং প্রতিটা আলাদা আলাদা গাড়ীর রক্ষীদের পরাভূত করে। গুজরাতি অশ্বারোহী বাহিনীর আরও সেনাসদস্য ঘোড়া দাবড়ে পালায় এবং পদাতিক বাহিনীর সেনা আর সেনাবাহিনীর সাথে আগত অন্যান্য লোকেরা এরপরে কে কত দ্রুত পালাতে পারে যেন তারই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
প্রতিরোধ শেষ- নিদেনপক্ষে এখনকার মতো। হুমায়ুন অবশ্য ভালো করেই জানে যে তাঁর সাথে যে লোক রয়েছে তাদের সংখ্যা বাড়াবাড়ি ধরনের কম আর এই বিষয়টা যখন গুজরাতি বাহিনীর আধিকারিকেরা লক্ষ্য করবে তখন তারা চেষ্টা করবে দলবদ্ধ হয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে। আর তাই নষ্ট করার মতো সময় তাঁদের হাতে নেই। হুমায়ুন তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ক্ষুদে দলকে আদেশ দেয় পলাতকদের পিছু ধাওয়া করতে আর তাঁদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ করার নির্দেশ দেয় কিন্তু কয়েক মাইলের বেশী ধাওয়া করতে নিষেধ করে এরপরে ফিরে এসে একটা চলনসই রক্ষণাত্মক ব্যুহ তৈরীর আদেশ দেয়। সে অন্য লোকদের মালবাহী গাড়িতে কি রয়েছে সেটা দেখতে বলে। তারা সাগ্রহে আদেশ পালন করতে এগিয়ে যায় এবং চটের ভারী আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলতে ভেতরে ছয়টা মাঝারি মাপের কামান, প্রয়োজনীয় বারুদ, কামানের গোলা আর সেই সাথে নতুন তৈরী করা বর্শার একটা গোছা আর পাঁচ বাক্স মাস্কেট দেখতে পায়।
আমরা মাস্কেটগুলো সব নেব। বাক্সগুলো খালি কর। আমাদের সাথে বাড়তি ঘোড়ার পর্যাণে মাস্কেটগুলো গোছা করে বেঁধে দাও। কামানের নলে যতগুলো বারুদ ভর্তি কাপড়ের ব্যাগ প্রবেশ করান যায়, প্রবেশ করাও আর তারপরে মাটিতে বারুদের একটা রেখা তৈরী করে ওখানে ঐ পাথরের পেছনে নিয়ে যাও। পাথরের পেছন থেকে আমরা বারুদে অগ্নি সংযোগ করবো, হুমায়ুন বলে।