জওহর মাথা নাড়ে এবং ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে রওয়ানা দেয়। হুমায়ুন যখন তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে পাহাড়ের ঢালের কিনারা থেকে সরে এসে পূর্ব নির্ধারিত মিলনস্থলের দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়, সে নিজের ভিতরে আশঙ্কা আর উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি নিজের ভিতরে অনুভব করে যুদ্ধের আগে সব সময়ে তার এমনই অনুভূত হয়, কিন্তু পূর্বের চেয়ে এবার দায়িত্ববোধের একটা বাড়তি বোঝা সে নিজের উপরে অনুভব করে। পূর্বে, তার মরহুম আব্বাজান, তিনি যদি সমূহ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজে উপস্থিত নাও থাকতেন, পুরো অভিযানের সামগ্রিক পরিকল্পনা অনুমোদন করতেন আর সিংহাসন তাঁর আব্বাজানের এক্তিয়ারভুক্ত- তার নিজস্ব নয়- যা ছিল হুমকির মুখে। ভাবটা মাথায় আসতেই হুমায়ুনের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় এবং সে তার সাথের লোকদের কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করতে আদেশ দেয়। সে কি নিশ্চিত- যতটা নিশ্চিত তার পক্ষে হওয়া সম্ভব- যে তার পরিকল্পনা কার্যকরী হবে- সে কি অভিযানের প্রতিটা অনুষঙ্গ যথেষ্ট সময় নিয়ে যাচাই করেছে যাতে ভাগ্যের উপরে যতটা কম সম্ভব নির্ভর করতে হয়? সে যখন এসব ভাবনায় বিপর্যস্ত তখন সে দুটো খয়েরী রঙের অতিকায় বাজপাখিকে পাহাড়ী ঢলের আড়াল থেকে অনায়াস স্পর্ধায় উপরের মেঘহীন নীল আকাশের দিকে উড়ে যেতে দেখে প্রসারিত ডানায় উষ্ণ বাতাসের বরাভয় তাদের ঊর্ধ্বমুখী উড়ান নিশ্চিত করেছে। সহসা তাঁর মনে পড়ে যায় পানিপথের যুদ্ধের সময় দেখা সেই ঈগলদের কথা যা একটা শুভ লক্ষণ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই পাখিগুলোও নিশ্চিতভাবেই সেটাই আবারও প্রমাণিত করবে যখন সে তার গুজরাত অভিযানের প্রথম আঘাত হানতে চলেছে।
নিজের সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, হুমায়ুন তার অবশিষ্ট বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য নির্ধারিত মিলনস্থলে পৌঁছে। পুরো বাহিনী রণসাজে বিন্যস্ত হওয়া মাত্র, হুমায়ুন দ্রুত আক্রমণের আদেশ দেয় যা দুটো উপর্যুপরি ঢেউয়ের মতো পরিচালিত হবে। খাড়া উত্রাই বেয়ে বল্পিতবেগে নীচের দিকে ঘোড়া নিয়ে ধেয়ে আসা আক্রমণের প্রথম স্রোত, শত্রুর সেনাসারির পেছনের দিকটা সম্পূর্ণভাবে মোকাবেলা করবে। আক্রমণের পরের স্রোতটা সেনাসারির সামনের যোদ্ধাদের পুরোপুরি ঘিরে ফেলবে যখন তারা থমকে থেমে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে তখন তাদের মাঝে সৃষ্ট বিভ্রান্তি কাজে লাগিয়ে আক্রান্ত পেছনের যোদ্ধাদের সহায়তা করতে সম্মুখের যযাদ্ধারা এহেন আচরণ করতে বাধ্য। হুমায়ুন ময়ান থেকে তার আব্বাজানের প্রিয় তরবারি আলমগীর বের করে এর রত্নখচিত বাটে চুমু খায় এবং তার লোকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, তোমাদের মনে নিয়ে এসো যোদ্ধার তেজস্বিতা আর কণ্ঠে বীরের দম। আমাদের সদ্য জয় করা ভূখণ্ড রক্ষার জন্য আমরা লড়াই করছি। এসব অহঙ্কারী ভূঁইফোড়দের কাছে আমরা প্রমাণ করবো যে সাহসিকতার জন্য আমাদের সনাতন খ্যাতি আমরা হারিয়ে ফেলিনি। তারপরে মাথার উপরে উত্তোলিত তরবারি আন্দোলিত করে হুমায়ুন আক্রমণের ইঙ্গিত করে এবং কাছাকাছি অবস্থানরত দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে তাঁর বিশাল কালো স্ট্যালিয়নের পাঁজরে খোঁচা দিয়ে ঢাল বেয়ে আক্রমণের জন্য ধেয়ে যায়।
পাহাড়ের গা বেয়ে তারা যখন নীচের দিকে ধেয়ে আসে, পাথরকুচি আর লাল ধূলো তাদের চারপাশে উড়তে থাকে, এরই ভিতরে সে তার সামনে গুজরাতি সেনাদলকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে যখন লোকগুলো তাঁর দিকে ঘুরে তাকায় কিসের এতো শোরগোল সেটা দেখতে। পুরোপুরি অপ্রস্তুত গুজরাতিরা প্রথমে ইতস্তত করে এবং তারপরে তাদের জন্য সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এমন শ্লথ ভঙ্গিতে তাঁরা তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে শুরু করে, তাদের যুদ্ধাস্ত্রের জন্য হাতড়াতে থাকে এবং চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে তাদের আধিকারিকদের খোঁজে দেখতে চায় তাদের কি আদেশ। কালো শুশ্রুমণ্ডিত এক লোক বাকিদের চেয়ে অনেক দ্রুত, লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামে এবং তার পর্যাণের সাথে মোটা কাপড়ের ব্যাগের সাথে বাঁধা মাস্কেট টেনে বের করতে চেষ্টা করে।
হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখ বন্দুকধারীর দিকে ঘুরিয়ে দেয় এবং ডানহাতে নিজের তরবারি আকড়ে ধরে সে যখন তার ঘোড়ার গলার কাছে নুয়ে এসে তার বাহনকে বিড়বিড় করে সামনে ধেয়ে যেতে বলে, নিয়তি আর নেতৃত্বের সব ভাবনা তার মন থেকে তিরোহিত হয়ে সেখানে ভর করে মারা, মরা, বেঁচে থাকার আন্ত্রিক প্রবৃত্তি। নিমেষের ভিতরে সে লোকটার কাছে পৌঁছে যায়, যে তখনও তার মাস্কেটে বারুদ ভরার জন্য কসরত করে চলেছে। হুমায়ুন তার শশ্রুমণ্ডিত মুখ বরাবর তরবারি চালায় এবং লোকটার ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলে সে মাটিতে আক্রমণকারী অশ্বারোহী বাহিনীর খুরের নীচে পরে যায়। হুমায়ুন ততক্ষণে শত্ৰুসারির অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, অশ্বারূঢ় হয়ে সামনে এগিয়ে যাবার সময়ে সে দুপাশে পাগলের মতো তরবারি চালাতে থাকে। অকস্মাৎ ভীড়ের মাঝ থেকে বের হয়ে আসতে সে তার হাঁপাতে থাকা, উত্তেজনায় নাক টানতে থাকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তার বাকি লোকেরা অচিরেই তার চারপাশে এসে জড়ো হয়।