ইত্যবসরে সে তার অভিযানের জন্য নির্বাচিত তার পছন্দের সেনাপতিদের বিষয়ে তাঁর ফুপু খানজাদার বিজ্ঞ পরামর্শের জন্য তাঁর সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করে এবং এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অন্য আরেকটা বিষয়ে সে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাথে আলোচনা করতে চায়। সে অভিযান পরিচালনা করতে যখন দূরদেশে যাবে তখন তাঁর সৎ-ভাইদের তাদের আপন আপন প্রদেশে স্বাধীনভাবে রেখে যাওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে- কামরান রয়েছে উত্তরপশ্চিম দিকে পাঞ্জাবে, আসকারি পূর্বদিকে জুনাপুরে আর হিন্দাল রয়েছে পশ্চিম দিকে আলওয়ারে? তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার এই সুযোগের কি তাঁরা সদ্ব্যবহার করবে? তাঁর কি উচিত তাঁর সেনাবাহিনীতে তাদের সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া এবং সাথে করে গুজরাতে নিয়ে যাওয়া যাতে সে তাদের উপরে লক্ষ্য রাখতে পারে?
তাদের নিজ নিজ প্রদেশ থেকে যে সংবাদ তার কাছে এসেছে তাতে এখনই উদ্বিগ্ন। হবার মতো কোনো কারণ নেই, বিশেষ করে হিন্দাল আর আসকারির ক্ষেত্রে তারা তাঁদের প্রশাসনিক বিষয়ের সবকিছু খুটিনাটি তাকে নিয়মিত লিখে পাঠায় এবং তাদের প্রদেয় কর পুরোপুরি প্রদান করে কখনও সময়ের আগেই। কামরানও তাঁর প্রদেশের রাজস্বের ন্যায্য হিস্যা ঠিকমতোই প্রদান করে যদিও তার প্রেরিত দাপ্তরিক বিবরণী অনিয়মিত আর সংক্ষিপ্ত। কখনও কখনও হুমায়ুনের দরবারের কোনো অসন্তুষ্ট কর্মকর্তা কামরানের প্রদেশে যায় সেখানে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে। আবার কখনও গুজব শোনা যায় যে কামরান তার প্রাদেশিক প্রয়োজনের তুলনায় বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে, কিন্তু এসবই শেষ পর্যন্ত ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয় বা আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমন বা অন্য কোনো কারণের দ্বারা সৈন্য সমাবেশের বিষয়টার ন্যায্যতা প্রতিপাদিত হয়।
কিন্তু কামরান তার উচ্চাকাঙ্খ পরিত্যাগ করার বান্দা না আর সে কেবল কালক্ষেপন করছে আর প্রস্তুত হচ্ছে হুমায়ুনের কোনো দুর্ভাগ্যকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহারের জন্য এই অনুভূতি থেকে হুমায়ুন কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তবে তাই হোক। কামরান কোনো কারণে যেন এমন কোনো সুযোগ না পায় সেটা সে নিশ্চিত করবে। সে যাই হোক, এমনও হতে পারে কামরানের, আর সেই সাথে আসকারি আর হিন্দাল, তাঁদের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে এবং তারা হুমায়ুনের মহানুভবতার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ যেমনটা তাঁদের কাছ থেকে কাম্য, তার এই বিচার ভুল হয়েছে। সে আশা করে তাঁর প্রথম ধারণাটাই সঠিক। যদি কোনো কারণে ব্যাপারটা এমন না হয়, তাঁর নানাজান আগ্রা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাহাদুর শাহর বিপক্ষে কোনো ধরনের অভিযান শুরু করবে না। তিনি এবং হুমায়ুনের উজির কাশিম কাবুল থেকে ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই দিল্লীতে শাহী খাজানা পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন, আশা করা যায় কয়েক দিনের ভিতরেই তারা ফিরে আসবেন। হুমায়ুন তখন তার অনুপস্থিতিতে বাইসানগারকে রাজপ্রতিভূ নির্বাচিত করবে। সে তার নানাজানকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে- সেই সাথে কাশিম আর খানজাদাকেও তারা তাঁর কলহপ্রিয় সৎ-ভাইদের উপরে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
তাঁরা তাঁর আম্মিজানকেও দেখে রাখবে। বাবরের অসময়োচিত মৃত্যুর পরে পার্থিব বিষয়ে মাহামের যে সামান্য আগ্রহ ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নিজের সন্তান সম্রাট হবার কারণে সে যদিও গর্বিত কিন্তু সে কখনও তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করে না বা খানজাদার মতো তাকে কোনো পরামর্শও দিতে আসে না। হুমায়ুন তাঁর সাথে যেটুকু সময় কাটায় সে তখন আকুল হয়ে কেবলই অতীতের কথা রোমন্থন করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে হয়তো বুঝতে পারবে যে ভবিষ্যতের ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকাই এখন হুমায়ুনের জন্য বাঞ্ছনীয়।
*
একটা বেলেপাথরের পাহাড়ী ঢালের উপর থেকে হুমায়ুন বাহাদুর শাহের সৈন্যদের লম্বা সারির দিকে তাকিয়ে থাকে, যারা তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন, চারশো ফিট নীচে নদীর তীর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগোবার সময়ে পায়ের আঘাতে ধূলোর মেঘ সৃষ্টি করছে। বছরের এই সময়ে- মার্চ মাসের গোড়ার দিকে, সে আগ্রা ছেড়ে আসবার পরে ইতিমধ্যে দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে- নদীর বেশীর ভাগ অংশই শুকিয়ে গিয়েছে কেবল নদীগর্ভের গভীর অংশে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত জলাশয় বিরাজ করছে। নদীর তীরে একটা বেমানান তালগাছ সবুজের স্পর্শ হয়ে বিরাজ করছে। হুমায়ুন সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত পদাতিক সেনাদলের সামনে পিছনে অশ্বারোহীবাহিনীর ছোট দল দেখতে পায় এবং এসব আয়োজনের ঠিক মধ্যে একটা মালবাহী গাড়ির একটা বিশাল সারি।
সাফল্যের হাসি লুকিয়ে রাখতে অপারগ, হুমায়ুন তার পর্যাণের উপরে ঘুরে বসে জওহরের সাথে কথা বলার অভিপ্রায়ে, এই অভিযানে তাঁর অনুচর- কর্চি হিসাবে সে তার সাথে এসেছে। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমাদের প্রেরিত রেকিদল ভালোই কাজ দেখিয়েছে আর আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে গুজরাতিদের কোনো ধারণাই নেই। এখন দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে পেছনে যার যেখানে আমরা আমাদের বাকি সঙ্গীসাথীদের রেখে এসেছি। তাদের বলবে আমার আদেশ পাহাড়ী ঢাল বরাবর তাঁরা এগিয়ে আসবে, কিনারা থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে যেন নীচে থেকে তাদের কেউ দেখতে না পায় যতক্ষণ না তারা মাইলখানেক বা আরো কিছুটা সামনে যেখানে ঢালটার নতি অনেকটা সহনীয় হয়ে এসেছে আমাদের শত্রুর উপরে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে। তাদের বলবে আমি আমার দেহরক্ষীবাহিনী নিয়ে সেখানে তাদের সাথে যোগ দিব।